বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানতে চান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব কতটা গুরুত্বপূর্ণ।কেননা আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণ রূপে জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল।এ দেশের কৃষিকাজে সাফল্য সম্পূর্ণ রূপে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সংঘটিত বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল।

ভূমিকা

কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সম্পূর্ণরূপে জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল। কারণ এদেশে শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল।জাতীয় আয়ের শতকরা ১৬.৯৮ ভাগ কৃষি থেকে অর্জিত হয়।কৃষি কাজে সাফল্য আবার সম্পূর্ণরূপে জলবায়ুর আনুকুল্যের উপর নির্ভর করে। তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব সবচেয়ে বেশি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

১) কৃষির উপর জলবায়ুর প্রভাব

বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও কৃষি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় আশানুরূপ সাফল্য লাভ করতে পারেনি। কারণ এদেশের কৃষির উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ুর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। নিম্নে কৃষির উপর জলবায়ুর প্রভাব আলোচনা করা হলো:

ক) পানি সরবরাহ

পরিমিত পানি উদ্ভিদের বৃদ্ধি, পুষ্টি ও ফলবতী হওয়ার পূর্বশর্ত।বাংলাদেশে সেচের অধীন কৃষি জমির পরিমাণ মোট আবাদি জমির মাত্র ১২%। এজন্য বাংলাদেশের কৃষি জলবায়ু তথা বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভরশীল।আবার বাংলাদেশের প্রধান ফসল ধান, পাট, ইক্ষু, চা প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য কৃষি জমিতে প্রচুর পরিমাণে পানির প্রয়োজন।


তাছাড়া মাটির পানি ধারণ ক্ষমতার উপর মাটির উর্বরতা তথা কৃষির উৎপাদন নির্ভর করে।এছাড়া বাংলাদেশের বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত বর্ষাকালে হয় বলে এই সময় অধিক পরিমাণ জমিতে খাদ্য শস্য উৎপাদন সম্ভব হয়।তাছাড়া জলবায়ু উষ্ণ,আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন বলে ধান, পাট, ইক্ষু, চা প্রভৃতি ফসল ভালো জন্ম।

খ) জমি চাষ

মৃত্তিকার আদ্রর্তা বীজের অঙ্কুরোদগমের পূর্বশর্ত। তবে বাংলাদেশের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র হওয়ায় জমিতে চাষ দেওয়ার সময় মৃত্তিকার আদ্রর্তা বজায় থাকে।বর্ষাকালে অত্যাধিক বৃষ্টিপাতের জন্য মৃত্তিকা আদ্রর্তা বেড়ে যায়। মৃত্তিকার আর্দ্রতা বজায় থাকলে ধান, পাট, ইক্ষু, চা প্রভৃতি ফসল প্রচুর পরিমাণে জন্মে।

গ) ফসল উৎপাদন

ধান, পাট, চা, ইক্ষু ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য অধিক উত্তাপ, বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার প্রয়োজন। আবার ডাল, তৈলবীজ,গোল আলু,পেঁয়াজ,রসুন প্রভৃতি উৎপাদনের জন্য সামান্য উত্তাপ ও বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হয়। তাই শীতকালে এদেশে শাকসবজি, তৈল বীজ, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি জন্মে।

ঘ) উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধি

বাংলাদেশের কৃষির উপর মৌসুম বৃষ্টিপাতের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।যে বছর নিয়মিত ও পরিমিত বৃষ্টি হয় সে বছর উৎপাদন ভালো হয়। আর যে বছর বৃষ্টিপাত অত্যাধিক কিংবা স্বল্প ও অনিয়মিত হয় দেখা যায় সে বছর উৎপাদন ব্যাহত হয়।কম বৃষ্টিপাতের ফলে খরা দেখা দেয়।


সুষ্ঠু সেচ ব্যবস্থার অভাবে অধিকাংশ জমির ফসল নষ্ট হয়ে যায়।অধিক বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা দেয়। ফলে কৃষকরা তাদের ফসল আর বাড়িতে তুলতে পারে না।তাছাড়া কালবৈশাখী ঝড়ে বহু ফসল নষ্ট হয়।

ঙ) কৃষি নির্ভর শিল্প

বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানা কৃষি পণ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। জলবায়ু অনুকূলে থাকলে যেসব শিল্প কৃষি পণ্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় সেসব শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। তাছাড়া অন্যান্য কাঁচামাল, শ্রমিক, পরিবহন প্রভৃতির উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে।

২) শিল্পের প্রসার

শিল্পের উপর জলবায়ুর প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকলেও পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্প- কারখানাই কৃষি নির্ভর।এক্ষেত্রে পাট শিল্প, চা শিল্প, চিনি শিল্প, তামাক শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কাগজ শিল্প প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা যায়। জলবায়ু সহায়ক হলে প্রচুর পরিমাণ শিল্পের কাঁচামাল উৎপন্ন হয় এবং শিল্প-কারখানাকে সমৃদ্ধ করে তোলে।


এছাড়া কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। ফলে তারা শিল্পজাত দ্রব্য বেশি ক্রয় করে। এতে শিল্পের প্রসার ঘটে এবং শিল্পজাত দ্রব্য রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়। শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে বেকার সমস্যা দূরীকরণ সম্ভব হয়। সুতরাং বাংলাদেশের শিল্প-কারখানা তথা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম।

৩) মৎস্য উৎপাদন

বর্ষাকালে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে নদ-নদী, খাল-বিল,পুকুর-ডোবা ইত্যাদি পানিতে ভরে যায় এবং প্রচুর পরিমাণে মৎস্য জন্মায়। কারণ বৃষ্টির পানি মৎসের প্রজনন, জন্ম ও বৃদ্ধির জন্য অধিক উপযোগী।দেশের মৎস্য শিল্প বহুলাংশে জলবায়ুর উপর নির্ভরশীল যা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

৪) পরিবহন ও যোগাযোগ

সহজ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা জলবায়ুর উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আর মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে এদেশের নদ-নদী নাব্য হয়ে উঠে।ফলে জলপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন সহজতর হয়। উল্লেখ্য, এদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পণ্যসামগ্রি নদীপথে পরিবাহিত হয়ে থাকে।তাই নদীমাতৃক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জলপথের গুরুত্ব অপরিসীম যা জলবায়ু দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে।

৫) ব্যবসা-বাণিজ্য

ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। অনুকূল জলবায়ুতে কৃষিজ, শিল্পজ, বনজ ইত্যাদি সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত পণ্য-দ্রব্য অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রবেশ করে।ফলে দেশ বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম হয়।

৬) জীবজন্তু

বাংলাদেশে যেসব জীবজন্তু বসবাস করে তারা জলবায়ু দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের জীবজন্তুর মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া, কুকুর, বিড়াল, বাঘ বানর, গাধা, হাতি, শুকুর, ঘোড়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশে এসব তৃণভোজী ও মাংসাশী জীবজন্তুর বসবাসের জন্য এ জলবায়ু বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এসব জীবজন্তু দেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

৭) জাতীয় আয় বৃদ্ধি

বাংলাদেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির উপর জলবায়ুর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।কেননা জলবায়ুর প্রভাবে কৃষিজ, বনজ, মৎস্য প্রভৃতি সম্পদের বৃদ্ধি ঘটে। ফলে এগুলো দেশের মোট জাতীয় আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ ত্বরান্বিত করতে সাহায্য করে।

৮) রপ্তানি বাণিজ্য

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের উপর জলবায়ুর প্রভাব অত্যাধিক। কারণ অনুকূল জলবায়ুতে কৃষি, শিল্প ও বনজ সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে রপ্তানি বাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হয় যা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখে।

৯) কর্মসংস্থান সৃষ্টি

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জলবায়ু বিশেষভাবে সহায়তা করে থাকে। কেননা এ দেশের অনুকূল জলবায়ুর প্রভাবে বিভিন্ন শিল্পের বিকাশ ঘটে। আর এ শিল্প-কারখানার জন্য প্রচুর লোক নিয়োগ করতে হয়। যার ফলে অধিক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়। এছাড়া দেশের বেকার সমস্যা অনেকাংশে হ্রাস পায় এবং জনসাধারণের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।

১০) জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে জলবায়ু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।এদেশের শতকরা প্রায় ৭৫ জন লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল।সময়মতো ও পরিমিত বৃষ্টিপাত হলে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।যার ফলে দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পায়।ফলে জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে।

১১) বনজ সম্পদ

বাংলাদেশ বনজ সম্পদে মোটামুটি সমৃদ্ধ। এখানকার জলবায়ুতে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় বলে বনভূমি গড়ে উঠে। কিন্তু জলবায়ু শুষ্ক হলে বনভূমি গড়ে উঠত না। বনভূমি মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় বাঁশ, কাঠ ও জ্বালানি সরবরাহ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তা করে থাকে।তাই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনজ সম্পদের গুরুত্ব রয়েছে।

১২) মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি

নদীমাতৃক বাংলাদেশে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করতে জলবায়ু বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। জলবায়ুর প্রভাবে অত্যাধিক বৃষ্টিপাত হলে মাঠ-ঘাট পানিতে ডুবে যায়।যার ফলে ছোট ছোট বৃক্ষলতা পানিতে ডুবে যায়। পরবর্তীতে এগুলো পচে জৈব সার তৈরি হয়। এছাড়াও বন্যা হলে নদী থেকে যে পলি মাটি কৃষি ভূমিতে জমা হয় তাতেও ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। ফলে জমিতে অধিক ফসল উৎপন্ন হয়।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন জলবায়ুর উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।এছাড়া জলবায়ু বিরূপ হলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হয়, যার ফলে শিল্পে কাঁচামালের স্বল্পতা দেখা দেয়।ফলে শিল্পের প্রসারে ব্যাঘাত ঘটে। যার ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ও দেখা দেয়। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব অপরিসীম।সুতরাং আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জলবায়ুর প্রভাব বর্ণনা করা হয়েছে।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url