ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ-ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ-ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।কারণ আজকের আর্টিকেলে ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ-ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
বায়ুমন্ডলে ওজোন গ্যাস দ্বারা সৃষ্ট পুরু আবরণকে ওজোন স্তর বলা হয়। এ ওজোন স্তর পৃথিবীতে জীব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
ভূমিকা
ওজোন এক ধরনের কটু গন্ধযুক্ত গ্যাস। বায়ুমন্ডলে সামান্য পরিমাণে এর অবস্থিতি।ওজোন গ্যাস বায়ু মন্ডলের সর্বোচ্চ ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।এটি প্রধানত অক্সিজেন অণু দ্বারা গঠিত।অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু নিয়ে একটি ওজোন অণু গঠিত হয়।বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ারে ১২-৩৫ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত ওজোন গ্যাসের পুঞ্জিভবন সঠিকভাবে হওয়াতে ঐ অঞ্চলটি ওজোনোস্ফিয়ার বা স্ট্রাটোস্ফেরিক ওজোন স্তর নামে অভিহিত।এই ওজোন স্তরটি সূর্যের অতি ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মি শোষণ করে থাকে।এ স্তরটি না থাকলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির দহনে প্রাণীর দেহ পুড়ে যেত এবং সমস্ত প্রাণীকুল অন্ধ হয়ে যেত। অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করায় এই স্তরের তাপমাত্রা (প্রায় ৭৬°সেলসিয়াস) অনেক বেশি।
ওজোন স্তর ক্ষয়
ওজোন স্তর সম্পর্কে পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পৃথিবীর জীব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ওজোন স্তর সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে জীব প্রজাতিকে রক্ষা করে বলে একে'পৃথিবীর প্রাকৃতিক সৌর পর্দা' বলা হয়। বিভিন্ন কারণে জীব প্রজাতির জন্য আবশ্যকীয় এ প্রাকৃতিক উপাদান ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে যাচ্ছে।ওজোন স্তরের ক্ষয়ের কারণে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি পৃথিবী পৃষ্ঠে চলে আসে এবং মানুষ ও অন্যান্য প্রাণী এবং উদ্ভিদের ক্ষতিসাধন করে।
ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ
ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য প্রাকৃতিক এবং মনুষ্য সৃষ্ট উভয় কারণ দায়ী।বর্তমানে মানুষের বিভিন্ন কর্ম কান্ডের ফলে ওজন স্তর দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।তাই ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য মানুষের কর্মকান্ডকে প্রধান দায়ী করা হয়।ওজোন স্তর ক্ষয়ের ফলে সৃষ্ট ওজোন ছিদ্রের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। সম্প্রতি মেরু অঞ্চলে সৃষ্ট ওজোন ছিদ্রের বিস্তৃতি বৃদ্ধির বিষয় বিজ্ঞানী, গবেষক ও বিভিন্ন মহলের নিকট উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য প্রধানত তিনটি কারণকে চিহ্নিত করা যেতে পারে। যথা-
- বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ
- নিম্ন তাপমাত্রা এবং
- সূর্যালোকের অনুপস্থিতি
১) বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থ
বিভিন্ন গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে অন্যতম ক্লোরিন সৃষ্ট বিভিন্ন যৌগ ওজোন স্তরের ক্ষয়সাধন করে। এছাড়াও স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তরে অবস্থিত হাইড্রোজেন ক্লোরাইড, ক্লোরিন নাইট্রেটকে ওজোন স্তর ক্ষয়ের জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়।শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র,রেফ্রিজারেটর,অ্যারোসল,ফোম কারখানা,স্প্রেমেশিন অগ্নিনির্বাপন যন্ত্র, শুষ্ক পরিষ্কারক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি প্রভৃতি ব্যবহারের ফলে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন উৎপন্ন হয়।এ গ্যাসের বাণিজ্যিক নাম 'ফ্রেয়ন'।শিল্প-কারখানা, অফিস-আদালত এবং গৃহে ব্যবহৃত সামগ্রী থেকেই এ গ্যাসের বেশিরভাগ উৎপন্ন হয়।আর এইসব গ্যাস সমূহ ওজোন স্তর ক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ।
আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের উৎক্ষিপ্ত সালফার ডাই অক্সাইডসহ অন্যান্য সালফেট জাতীয় আস্তরণ বায়ুমণ্ডলের ওজোনের সাথে বিষক্রিয়া করে এর বিনাশসাধন করে। এছাড়াও বিভিন্ন যানবাহন ও শিল্প কলকারখানা থেকে নির্গত সালফেটসমৃদ্ধ ধোয়া বায়ুমণ্ডলের ১৫-২২ কিলোমিটার উর্ধ্বে সঞ্চিত হচ্ছে। আর এই সঞ্চিত সালফারের অক্সাইডসমূহ ক্যাটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ওজোন স্তরকে ধ্বংস করছে। এছাড়াও ওজোন স্তর ধ্বংসকারী আরেকটি গ্যাস হলো মিথেন। জলাভূমিতে, পানির নিচে পানা, নানা জাতীয় পাতা ও বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদের পচনের ফলে এই গ্যাস সৃষ্টি হয়।
ক্লোরোফ্লোরো কার্বন উৎপন্ন হওয়ার পর থেকে বায়ুমন্ডলে ৫০ থেকে ২০০ বছর পর্যন্ত অবস্থান করতে পারে। এ গ্যাস নিষ্ক্রিয়। অদাহ্য এবং সাধারণ তাপমাত্রায় গ্যাসীয়।এসব রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য এ গ্যাসকে দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকতে সহায়তা করে।বায়ুমন্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তরে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন অবস্থান করে এবং ওজোনের ক্ষয় সাধন ঘটায়। ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস ভারী হওয়ায় বায়ুমন্ডলের ২০ কিলোমিটারের উর্ধ্বে খুব বেশি যায় না।
এ গ্যাস বৃষ্টির পানির সাথে ভূ-পৃষ্ঠে নেমে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এ গ্যাসের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি করে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ক্লোরোফ্লোরো কার্বনের ক্লোরিন পরমাণু বিচ্ছিন্ন করে।এছাড়াও বায়ুমণ্ডলের স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তরে বহুসংখ্যক অক্সিজেন পরমাণু থাকে।আর এ অক্সিজেন পরমাণু স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তরে ক্লোরিন পরমাণুর আবার পুনঃউৎপাদন করে।এভাবে ১ অনু ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বহুসংখ্যক ওজোন পরমাণু ধ্বংস করে।
২) নিম্ন তাপমাত্রা
নিম্ন তাপমাত্রা ওজোন স্তর ক্ষয়ের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে মেরু অঞ্চলে বছরে তিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সূর্যালোক পৌঁছায় না।সূর্যের আলো দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিতির কারণে মেরু অঞ্চল শীতল থেকে শীতলতর হয়ে যায়।ফলে মেরু অঞ্চলে সৃষ্ট নাইট্রিক এসিড থেকে কখনো কখনো ওজোন স্তরের ক্ষয়ের জন্য দায়ী ক্লোরিন নাইট্রেট উৎপন্ন হয়।আর এই ক্লোরিনের একটি যৌগ ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস ওজোন স্তরের ক্ষয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
৩) সূর্যালোকের অনুপস্থিতি
সূর্যালোকের অনুপস্থিতি ওজোন স্তরের ক্ষয়ের অন্যতম প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে পরিগণিত হয়। National Oceanic and Ajmospheric Administration (NOAA)-এর রসায়নিক সুসান সলোমন (Susan Solomon), পোলার স্ট্রাটোস্ফেরিক ক্লাউডস (PSCs-Polar Stratospheric Clouds) কিভাবে সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে ওজোন স্তর ক্ষয়সাধন করে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
বিশেষ করে মেরু অঞ্চলে বছরের ৩-৬ মাস পর্যন্ত সূর্যালোক পৌঁছায় না। সূর্যের আলো দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিতির ফলে মেরু অঞ্চলে শীতল থেকে শীতলতল হয়ে যায়। এ সময়ে অন্ধকার শীত তাপমাত্রা ৮০° সেলসিয়াসে নেমে আসে। নিম্ন বায়ু চাপ এবং শীতল আবহাওয়ার পোলার স্ট্রাটোস্ফোরিক ক্লাউডস (PSCs) উৎপন্ন হয়।PSCs তে হাইড্রোজেন ক্লোরাইড এবং ক্লোরিন নাইট্রেট অবস্থান করে।আর এই হাইড্রোজেন ক্লোরাইড এবং ক্লোরিন নাইট্রেট সৃষ্ট ক্লোরিন নিম্ন স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তরের ক্ষয়সাধন করে।
ওজোন স্তরের গুরুত্ব
বায়ুমন্ডলে ওজোন গ্যাসের পুরত্ব মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার। এই স্তর পৃথিবীর যাবতীয় জীবকুলের জীবন রক্ষাকারী স্তর হিসেবে চিহ্নিত।কারণ এটি সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে পৃথিবী তথা জীবকুলকে অতিরিক্ত উত্তাপ হতে রক্ষা করে।মহাজাগতিক অতিবেগুনি রশ্মি প্রাণী ও উদ্ভিজ্জের জন্য হুমকি স্বরূপ।আর এই রশ্মির ক্ষতিকর অংশের নাম আল্ট্রাভায়োলেট-বি,যা ওজোন স্তরে শোষিত হয়।
অপরদিকে আল্ট্রাভায়োলেট-ডি মানব স্বাস্থ্য, প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জন্য অতি উপকারী যা' ভূ-পৃষ্ঠ পর্যন্ত পৌঁছায়।ওজোন স্তর এক্ষেত্রে সৌররশ্মির ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে।ওজোন স্তর বায়ুমণ্ডলের তাপের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বিশেষত: স্ট্রাটোস্ফিয়ারের তাপ কাঠামো সংরক্ষণে ওজোন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সৌর বিকিরণের দৃশ্যমান অংশ চ্যাপিয়াস ব্যান্ড এবং অতিবেগুনি অংশ হার্টলী ও হাগিনস ব্যান্ড দ্বারা শোষিত হয়।
ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য
ওজোন গ্যাসের স্তর মূলত:স্ট্রাটোস্ফিয়ারের মধ্যে অবস্থান করে। তবে কোন কোন বিজ্ঞানী একে আলাদা স্তর হিসাবে বিবেচনা করেন।নিম্নে ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো:
- ওজোন হল অক্সিজেনের 'আইসোটোপ' অর্থাৎ অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু বিশিষ্ট একটি রূপ।
- ওজোন একটি হালকা, নীল রঙের তীব্র গন্ধযুক্ত উত্তেজক গ্যাস।
- ওজোন গ্যাসের সৃষ্টি এবং ধ্বংস একটি ভৌত রাসায়নিক প্রক্রিয়া।
- সাধারণত বায়ুমন্ডলের মধ্যে অক্সিজেন অণুর সঙ্গে একটি স্বতন্ত্র অক্সিজেন পরমাণু সংযোজনের ফলে ওজোন গঠিত হয়।
- এই ওজোন মন্ডলের সর্বত্র গ্যাসটি সমান নয়।কারণ ওজোন যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি আবার ধ্বংসও হয়। এই প্রক্রিয়ার গতি সব সময় ধীরে ও অবিরাম।
- ওজোন স্তরের প্রধান কাজ হল সূর্যের অতিবেগুনি আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করা। স্তরটিকে প্রকৃতপক্ষে ফিল্টারের সাথে তুলনা করা যায়।এটা আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি যে পরিমাণ প্রয়োজন শোষণ করে এবং বাকিটা পৃথিবীতে পৌঁছায়। সামান্য পরিমাণ আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি প্রাণী জগতের জন্য হিতকর।কিন্তু পরিমাণ বাড়লে ত্বকের ক্যান্সার,অন্ধত্বসহ নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি হয়ে প্রাণীকুল ধ্বংস হয়ে যেত।
- ওজোন স্তরের পুরত্ব বেশি নয় (৩ কি.মি.) তবে আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি শোষণ করাতে এর তাপমাত্রা বেড়ে যায়।প্রতি কিলোমিটার তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ৫°সে.।
- মূল ওজোন স্তরের বাইরেও স্ট্রাটোস্ফিয়ারে বিচ্ছিন্নভাবে ওজোন ছড়িয়ে আছে।এক হিসাব মতে ওজোন স্তর ১% ক্ষয় হলে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির আগমন ২% বেড়ে যায়।১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত ওজোন স্তর বিভিন্ন স্থানে ৫%-৯% পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছিল।তবে আশ্চর্যজনকভাবে ২০০৫ এর পর থেকে ওজনের ক্ষত কিছুটা পূরণ হয়েছে বলে জানা যায়।
শেষ কথা
বায়ুমন্ডলে ওজোন গ্যাস অস্থিতিশীল। কারণ এটা ধ্বংস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় আবার ধ্বংস হয়। ওজোন গ্যাসের সৃষ্টি এবং ধ্বংস বায়ুমন্ডলের ক্রমান্বয়িক ও ধারাবাহিক ঘটনা।অক্সিজেনের অনুসমূহ ঊর্ধ্ব আকাশে ৮০-১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে (Influence of ultra violet x-ray) অথবা বজ্রপাতের সময় ভেঙ্গে আলাদা হয়ে যায়। ওজোন স্তর পৃথিবীতে জীব প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। আজকের আর্টিকেলে ওজন স্তরের ক্ষয়ের কারণ-ওজোন স্তরের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশাকরি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।