খরা প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা কর
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে খরা প্রতিরোধের উপায় বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করব। কারণ খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের পক্ষে প্রতিরোধ করা কঠিন। তবে সময়মতো পদক্ষেপ নিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
খরা অধিক মারাত্মক অস্বাভাবিক বিপর্যয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা বিশ্বের সর্বত্র আঘাত হানে। কৃষি জমিতে বৃষ্টির অপ্রতুলতা থেকে খরার সৃষ্টি হয়। আজকের আর্টিকেলে খরা প্রতিরোধের উপায় বর্ণনা করা হলো।
খরা প্রতিরোধের উপায়
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা সমগ্র বিশ্বে নীরবে ধ্বংস লীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।তবে বন্যা, সুনামি এবং অন্যান্য দুর্যোগের মতো খরার প্রাথমিক ভবিষ্যৎ বাণী করা সম্ভব নয়।তাই তীব্র খরা দেখা দিলে এর প্রভাব কমানোর কোনো উপায় নেই। তাই খরা প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উপযুক্ত।
তাই খরা প্রতিরোধের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি, চাষের জমি বৃদ্ধি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা প্রভৃতি সম্ভব।সুতরাং খরা প্রতিরোধের বিষয় বর্তমানে উপজীব্য হয়ে উঠেছে। খরা প্রতিরোধের জন্য যেসব উপায় বা কৌশল গ্রহণ করা হয় সেগুলো নিম্নরূপ:
১)লবণাক্ততা দূরীকরণ
খরা সৃষ্টির ক্ষেত্রে লবণাক্ততা একটি অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচ্য। সমুদ্রের পানি ভূ-ভাগে প্রবেশ করে লবণাক্ততা সৃষ্টি করে। লবণাক্ততা দূরীকরণের মাধ্যমে খরা প্রতিরোধ করা সম্ভব।এছাড়া নদীর মোহনায় লবণাক্ততা দূরীকরণের জন্য প্লান্ট স্থাপন করা যেতে পারে।সমুদ্রের পানি যাতে লবণাক্ততা মুক্ত হয়ে ভূ-ভাগে প্রবেশ করে তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সৌদি আরব ও আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে প্লান্ট স্থাপন করে সমুদ্রের পানি লবণাক্ততা মুক্ত করে সেচ ও গৃহস্থলির কাজে ব্যবহার করা হয়।সমগ্র বিশ্বে এ মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে।
২) বৃষ্টির পানি ধারণ করা
বর্ষা মৌসুমে সৃষ্ট বৃষ্টির পানি জলাধার নির্মাণের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। শুকনো মৌসুমে এ পানি ব্যবহার করে খরা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। জলাধার নির্মাণ ছাড়াও বড় বড় পাত্রে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যেতে পারে।পূর্বেও দেখা গেছে যে, সিন্ধু সভ্যতায় বৃহৎ পরিসরে বৃষ্টির পানি ধারণ করে শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হতো।বর্তমান বিশ্বে চীন ও ব্রাজিলসহ বহু দেশে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে খরা প্রতিরোধের কাজে ব্যবহার করা হয়।
৩) পানি ব্যবহারে বিধি-নিষেধ
খরা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগটি পানিস্বল্পতার ফলশ্রুতিতে সৃষ্টি হয়। পানি অপচয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য পানি ব্যবহারের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা যেতে পারে। সরকারি প্রচেষ্টায় পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপ করা যায়।
৪) কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত সংঘটন
খরা প্রতিরোধের জন্য কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত সংঘটন করা যেতে পারে। সিলভার আয়োডাইড (silver iodide) এবং ড্রাই আইস (জমাটবাঁধা কার্বন ডাই-অক্সাইড) ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। চীনে সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সংগঠন করা হয়।এছাড়াও দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কেনিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ বহু দেশে এটি গ্রহণ করা হয়েছে।
৫)পানি বিশুদ্ধকরণ
গৃহস্থালি, কলকারখানা, যানবাহন প্রভৃতির ময়লা আবর্জনা এবং বর্জ্য পদার্থ পানির সাথে মিশে পানি দূষণ ঘটায়।দূষিত পানি বিভিন্ন রোগের বিস্তার ঘটায় এবং কৃষি ও শিল্প উৎপাদনে এ পানি ব্যবহার করা যায় না। প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে দূষিত পানি বিশুদ্ধকরণের মাধ্যমে ব্যবহার করা সম্ভব।বিশুদ্ধ পানি খরা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
৬) পুকুর ও জলাশয় খনন করা
খরা প্রবণ এলাকায় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার জন্য এবং খরার সময় প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করার জন্য অসংখ্য পুকুর ও গভীর জলাশয় খনন করা প্রয়োজন। অসংখ্য পুকুর,খাল ও জলাশয় খনন করতে পারলে সহজেই খরা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
৭) খরা সহনশীল গাছ ও ফসল উৎপাদন
খরা প্রবণ এলাকায় খরা সহনশীল ও খরা প্রতিরোধী গাছপালা ও ফসলের চাষ করা প্রয়োজন।এমন ফলজ বৃক্ষ লাগাতে হবে যেগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে বা যেগুলোতে পানি না দিলেও চলে যেমন-কলা, পেঁপে, আতা, বেল ইত্যাদি।এছাড়াও সয়াবিন, বাদাম, তেল প্রভৃতি ফসলও লাগানো যেতে পারে।তাই খরা প্রতিরোধ করতে হলে অবশ্যই প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগাতে হবে।কারণ গাছপালা ভূমিক্ষয় রোধ করে এবং বৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে পারে তথা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৮)পরিমিত ভূ-গর্ভস্থ জলের ব্যবহার
ভূ-গর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত ব্যবহার অবশ্যই কমাতে হবে।কারণ অতিরিক্ত ভূ-গর্ভস্থ জলের স্তর থেকে জল তোলা হলে মাটির আর্দ্রতা কমে যায়, যার ফলশ্রুতিতে খরা জনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।সুতরাং খরা প্রতিরোধ করতে চাইলে অবশ্যই পরিমিত ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।তাই খরা প্রতিরোধে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পর্যবেক্ষণ ও উত্তোলন কমানো অতি জরুরী।
৯)মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার ব্যবস্থা
খরা প্রতিরোধের জন্য অবশ্যই মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে।ধানের খড়, বিচালী, জাবড়া ইত্যাদির মাধ্যমে আচ্ছাদন দিয়ে জমির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা যায়।এছাড়াও ফসলি জমিতে অধিকারের জৈব সার ব্যবহার করা।খরা প্রতিরোধের জন্য মাটির আদ্রর্তা ধরে রাখার জন্য কৃত্রিম উপায়ে মাটি পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো উচিত।
১০)প্রয়োজনমত ফসলের ধরন পরিবর্তন
খরা প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী একটি পদক্ষেপ হলো প্রয়োজনমত ফসলের ধরন পরিবর্তন করা।এজন্য খরার মৌসুমে খরা সহনশীল ফসল চাষাবাদ করতে হবে এবং শীত ও কুয়াশার মৌসুমে শীত সহনশীল ফসল চাষাবাদ করতে হবে।তাহলে সহজেই খরা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
১১)মনিটরিং ব্যবস্থা
খরা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে মনিটরিং ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।এ প্রসঙ্গে ভৌত,জৈবিক এবং আর্থ-সামাজিক উপাদান মনিটরিংয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। মনিটরিং ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদান নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
ক) ভৌতিক উপাদান:বৃষ্টিপাতের পরিমাণ,পানি ব্যবহারে বিশ্লেষণ, বায়ু প্রবাহের মাত্রা, ভূমির উর্বরতা।
খ) জৈবিক উপাদান: শস্য উৎপাদন, বনভূমি, গবাদি পশু উৎপাদন।
গ) আর্থ-সামাজিক উপাদান: ভূমি মালিকানার ধরন, বাজার ব্যবস্থা, জনসংখ্যার হার, আয়, শিক্ষা, ভূমিক্ষয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা, মৎস্য উৎপাদন, অণুজীব, অভিগমনের হার, স্বাস্থ্য পুষ্টি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, দারিদ্র্য প্রভৃতি।
১২)গণসচেতনতা সৃষ্টি করা
পানি যে একটি সম্পদ এ বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।এছাড়াও পুকুর ভরাট করা, গাছপালা ধ্বংস করণ বা কেটে ফেলা, কলকারখানার দূষিত বায়ু পরিবেশের উষ্ণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে খরার সৃষ্টি করছে।তাই জনগণকে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।তাহলে খরা প্রতিরোধ করা সম্ভব।পুকুর ও গাছপালা পরিবেশকে আর্দ্র রাখে এবং খরা প্রতিরোধ করে এ বিষয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়াও পরিবেশবান্ধব কলকারখানা নির্মাণ করতে হবে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সাধারণত খরা বলতে বুঝায় ভূমিতে বা মাটিতে দীর্ঘ সময় ধরে পানির অনুপস্থিত বা বৃষ্টিপাত না হওয়া। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা কৃষি কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি স্বরূপ।সাধারণত বৃষ্টিপাতের অভাবের কারণে খরা সংঘটিত হয়। তবে বৃষ্টিপাত ছাড়াও আরো নানা কারণে খরা সংঘটিত হয়ে থাকে।আজকের আর্টিকেলে খরা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।