খরা মোকাবেলায় করণীয় কি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে খরা মোকাবেলায় করনীয় কি সেই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো। সাধারণত খরা বলতে বুঝায় ভূমিতে বা মাটিতে দীর্ঘ সময় ধরে পানির অনুপস্থিত বা বৃষ্টিপাত না হওয়া।

খরা মোকাবেলায় করণীয় কি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা কৃষি কাজের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।কৃষি ভূমিতে দীর্ঘ সময় ধরে পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা সৃষ্টি হলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দীর্ঘ ফসল উৎপাদনেও বাধাগ্রস্ত হয়। এরূপ পরিস্থিতিকে খরা বলে। সাধারণত বৃষ্টিপাতের অভাবের কারণে খরা সংঘটিত হয়।বৃষ্টিপাত ছাড়াও আরো নানা কারণে খরা সংঘটিত হয়ে থাকে।

ভূমিকা

খরা অধিক মারাত্মক অস্বাভাবিক বিপর্যয়। কারণ এগুলো যে কোন আকারে জীবের তিনটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে একটির অর্থাৎ পানির সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্ক বিশিষ্ট এবং পরোক্ষভাবে খাদ্যের সাথে সম্পর্ক বিশিষ্ট, কারণ ফসল এবং অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পূর্ণভাবে পানির উপর নির্ভরশীল।প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে খরা অন্যতম।


কৃষি জমিতে বৃষ্টির অপ্রতুলতা থেকে খরার সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে খরা বিশ্বের সর্বত্র আঘাত হানে।খরার ফলশ্রুতিতে ফসল উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি খরা সমগ্র সমাজব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে খরার প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

খরা কি?

খরা বলতে সাধারণভাবে বুঝায় দীর্ঘ সময় ধরে (যা কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত হতে পারে) ভূমিতে পর্যাপ্ত পানির অনুপস্থিতি।খরা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগটি কৃষি উৎপাদনের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। কৃষি উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। কৃষি ভূমিতে দীর্ঘ সময় ধরে পানি সরবরাহের অপ্রতুলতা সৃষ্টি হলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নতুন ফসল উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হয়। এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় খরা।


সাধারণভাবে বৃষ্টিপাতের অপ্রতুলতা থেকে খরার সৃষ্টি হয়। বিশ্বে স্বল্প বৃষ্টিপাত সংঘটিত এলাকায় খরার প্রবণতা সব সময় বেশি থাকে।বৃষ্টিপাতের স্বল্পতা ছাড়াও নানাবিধ কারণে খরা সংঘটিত হয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ে।

খরা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে Changron বলেন,'(1987) Drought is a complex and social phenomenon of widespread significance and despite all the problems droughts have caused,drought has been difficult to define.There is no universally accepted difinition because:

drought,unlike flood,is not a distinct event and drought is often the result of many complex factors acting on and interacting within the environment.Complicating the problem of drought is the fact that drought often has neither a distinct start rorend.It is usually recognizable only after a period of time and because a drought may be interrupted by short spells of one or more wet months,its termination is difficult to recognize.(ww.sws.wuc.edu)

খরার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা প্রদান না করা গেলেও এটি যে মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয় বয়ে আনে এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে খরাকে বিভিন্নভাবে চিহ্নিত করা হয়। লিবিয়ায় বার্ষিক ১৮০ মিলিমিটারের কম বৃষ্টিপাত সংঘটিত হলে তাকে খরা বলা হয়। আবার ইন্দোনেশিয়ার একটানা ৬ দিনের বেশি সময় ধরে বৃষ্টিপাত সংঘটিত না হলে তাকে খরা বলা হয়। মূলত বিশ্বের সর্বোচ্চ জলবায়ু এক রকম নয়। তাই একেক দেশে খরাকে একেক ভাবে চিহ্নিত করা হয়। বৃষ্টি হীনতাকে খরার মূল কারণ হিসেবে সাধারন ভাবে বিবেচনা করা হয়। বৃষ্টিহীনতা ছাড়াও অতিরিক্ত তাপমাত্রা,অতিমাত্রায় বায়ুপ্রবাহ,বাতাসের স্বল্প আর্দ্রতা প্রভৃতি খরার জন্য দায়ী।

খরা মোকাবেলায় জনসাধারণের করণীয়

১)গাছপালা খরা নিবারণ করে, তাই বাড়ির আনাচে-কানাচে, সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাঠে, বাঁধে ও রাস্তার ধারে প্রচুর গাছ লাগাতে হবে।

২)এমন ফলজ বৃক্ষসমূহ লাগাতে হবে, যেগুলো দীর্ঘদিন পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে বা যেগুলোতে পানি না দিলেও চলে যেমন-কলা, পেঁপে, আতা, বেল ইত্যাদি। সয়াবিন, বাদাম, তিল প্রভৃতি ফসলও লাগানো যেতে পারে।

৩)বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৪)পানি অপচয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য পানি ব্যবহারের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হবে।এছাড়াও পানির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিতকরণ করা।

৫)খরা মোকাবেলা করার জন্য অবশ্যই পরিমিত ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।এছাড়াও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর পর্যবেক্ষণ করা।

৬)খরা মোকাবেলার জন্য কৃত্রিম উপায়ে বৃষ্টিপাত সংঘটন করা যেতে পারে।সিলভার আয়োডাইড (silver iodide) এবং ড্রাই আইস (জমাটবাঁধা কার্বন ডাই-অক্সাইড) ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খরা মোকাবেলার জন্য এ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন-চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কেনিয়া ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বহু দেশ এটি গ্রহণ করেছে।

৭)পানি বিশুদ্ধকরন করতে হবে। কারণ বিশুদ্ধ পানি খরা মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

৮)ফিল্টারিং পদ্ধতিতে লবণাক্ততা দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়াও খরা মোকাবেলা করার জন্য পানি রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে পুনরায় ব্যবহার নিশ্চিত করা।

৯)বাড়িতে, পুকুরে, কুপে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

১০)খরা মোকাবেলায় গভীর শিকড় যুক্ত ফসলের আবাদ করা।

১১)খরার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা।এছাড়াও পানি যে একটি সম্পদ এই বিষয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। জনসাধারণকে পানির যথোপযুক্ত ব্যবহার সম্পর্কে সজাগ করা এবং কৃত্রিম উপায়ে মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো।

১২)খরা মোকাবেলা করার জন্য অধিকার হারে পুকুর ও খাল খনন করতে হবে।

১৩)দুর্যোগকালীন সময়ের জন্য শুকনো খাবার ও নগদ অর্থ মজুদ রাখতে হবে।

১৪)খরার প্রভাবে বিপর্যস্ত পরিবারগুলোর জন্য বিকল্প আয়ের উৎস খুঁজে বের করা।

১৫)গবাদি পশুর জন্য প্রয়োজনীয় খাবার মজুদ করতে হবে।

১৬) খরার পূর্বাভাস দেয়া এবং জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তা মোকাবেলার পরিকল্পনা নেয়া।

খরা মোকাবেলায় কৃষক সমাজের করণীয়

কৃষি বিজ্ঞানীরা "গাছ বৃদ্ধির জন্য যেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে রস থাকে না সে অবস্থাকে খরা" বলে থাকেন। সাধারণত বছরের ঐ সময়টাকে খরা বলা হয় যখন স্বাভাবিক অবস্থায় চারা গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার মতো পর্যাপ্ত রস মাটিতে থাকে না। এ অবস্থা অনাবৃষ্টির ফলে কিংবা সেচের অভাবেও হতে পারে। খরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক সমাজ।নষ্ট হয় মূল্যবান ফসল ও মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে কৃষি অর্থনীতিকে। সর্বস্ব হারিয়ে আবদ্ধ হয় দারিদ্র্যতা দুষ্টচক্রে। তাই ফসল ও জীবন রক্ষায় কৃষক খরিপ মৌসুমে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

১)সেচের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে গভীর ও অগভীর নলকূপ চালু করা।

২)সেচের দেশীয় পদ্ধতি সমূহ ব্যবহার করে সেচ দেওয়া।

৩)পুকুর, ডোবা, নালায় এবং জমির কোনায় গর্ত করে পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, সম্ভব হলে গাছ বৃদ্ধির স্তর অনুযায়ী সেচ দেয়া।

৪)মাটির গভীরে শিকড় প্রবেশ করে এমন ফসল চাষ করা এবং বেশি করে গাছ লাগানো চেষ্টা করা।

৫)রাসায়নিক সারের পরিবর্তে মাটিতে অধিক হারে জৈব সার ব্যবহার করা।

৬)খরা মোকাবেলা করার জন্য কৃষক সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো সেচের জন্য সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করা।

৭)খরা মোকাবেলা করার জন্য কৃষক সমাজের জন্য অবশ্যই কৃষি আধুনিকীকরণ করা প্রয়োজন।

৮)গতানুগতিক চাষের চেয়ে গভীর করে চাষ দেয়া।এতে নিচের ভেজা মাটি ওপরে উঠে শুকনো মাটিতে আদ্রর্তা বাড়াতে পারে। এছাড়াও প্রয়োজনমত ফসলের ধরন পরিবর্তন করা।

৯)নিড়ানী ও আঁচড়া প্রদানের মাধ্যমে মাটি থেকে পানির অপচয় কমানো।

১০)যে সকল জমিতে আগাছা ও জঙ্গল রয়েছে সেগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার করে রাখতে হবে যেন সঠিক সময়ে সঠিক ফসল চাষ করা যায় এবং সেখানে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়।

১১)ধানের খড়, বিচালী, জাবড়া ইত্যাদির মাধ্যমে আচ্ছাদন দিয়ে জমির আর্দ্রতা সংরক্ষণ করা।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, খরা মোকাবেলা করার জন্য উপরিউক্ত পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ করলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমানো সম্ভব।তাই খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচতে হলে পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে গাছ লাগানো অত্যন্ত জরুরী। আজকে আর্টিকেল খরা মোকাবেলায় করনীয় কি বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url