বন্যার প্রভাব-বন্যার ফলাফল
প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে আপনাদের বন্যার প্রভাব-বন্যার ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল। বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে এ যাবৎকালে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে।কারণ এর ক্ষয়ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ অনেক বেশি হয়ে থাকে।সমগ্র বিশ্বে এটি মানুষের জীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে। প্রতিবছর বন্যার কারণে বিপুল সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য প্রতিবছর বন্যা সংঘটিত হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জোরালো মত প্রদর্শন করেন। তবে যে কারণেই বন্যা সংঘটিত হোক না কেন এটি যে মানুষের জীবনের চরম ভোগান্তি বয়ে আনে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
বন্যা সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য দুঃখ-দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে।বন্যা এবং বন্যা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রোগ ব্যাধির বিস্তারসহ,অবকাঠামোগত ধ্বংস সাধন এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির বিষয় সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনুন্নত বিশ্বে এর প্রভাব সর্বদা বেশি পরিলক্ষিত হয়।
বন্যা কি?/বন্যা কাকে বলে
বন্যা বলতে সাধারন অর্থে নদী, খাল বা বিলে স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে অধিক পানি প্রবাহকে বুঝায় যা পার্শ্ববর্তী এলাকাকে প্লাবিত করে। বন্যায় নিম্ন ভূমি পানিতে ডুবে যায়। সাধারণত নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। নদী,খাল,বিল প্রভৃতির পানি ধারণের নিজস্ব ক্ষমতা বা সীমা থাকে। এ সীমার অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে নদী, খাল, বিল প্রভৃতি ছাপিয়ে পানি প্লাবনমুক্ত ভূমি তথা শুকনো ভূমিতে প্রবাহিত হয়।
আরো পড়ুন:বন্যার কারণ-বন্যার ক্ষতিকর প্রভাব
এর ফলে ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ, বনভূমি প্রভৃতি পানিতে ভরে যায়।পানির এরূপ চরিত্রকে বন্যা বলা হয়। বিশ্বে প্রতি বছর বন্যা আঘাত হানে। ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়। বন্যা সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যাকে নিয়ে গবেষণার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বন্যা সম্পর্কে বিস্তর গবেষণা পরিচালনা করছেন।এছাড়াও বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ বিভিন্নভাবে বন্যাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
বিশিষ্ট পানি বিশেষজ্ঞ Chow(১৯৫৬) বন্যা বলতে বুঝিয়েছেন, "বন্যা তুলনামূলকভাবে উচ্চতর প্রবাহ যা পানি প্রবাহের প্রাকৃতিক চ্যানেলের পাড় প্লাবিত করে।"
পানি বিজ্ঞানী Word বলেন, "বন্যা হলো পানি প্রবাহ,যা স্বাভাবিক অবস্থায় প্লাবন মুক্ত এমন ভূমিকে প্লাবিত করে।
Rostredt এর মতে, "বন্যা হলো অস্বাভাবিক প্রবাহ,যা প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম পানি প্রবাহের চ্যানেল প্লাবিত করে।"
উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে আমরা বলতে পারি যে, বন্যা হলো এমন অবস্থা যা উচ্চতর পানি প্রবাহের মধ্য দিয়ে প্লাবনমুক্ত ভূমিকে প্লাবিত করে দেয়। নদী,খাল ও বিলের ন্যায় সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির ফলেও বন্যার সৃষ্টি হয়। ফলে উপকূলবর্তী এলাকা পানিতে ডুবে যায়।
আরোপড়ুন:খরা কি-খরার প্রকারভেদ
বন্যার প্রভাব/ফলাফল
বন্যার পানি লোকালয়, মাঠ-ঘাট, হাট-বাজার, শহর-গঞ্জ প্রভৃতি স্থানে প্রবেশ করে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। সম্পদ হানি, পরিবেশ দূষণ, রোগ-ব্যাধির বিস্তারসহ বন্যা নানাবিধ প্রভাব ফেলে। বন্যার প্রভাব সমূহ নিম্নরূপ:
১) সম্পদ হানি
বন্যার পানি লোকালয়, মাঠ-ঘাট, শহর-গঞ্জ প্রভৃতি স্থানে প্রবেশ করে সম্পদ হানি ঘটায়। বন্যার তান্ডব লীলায় ভেসে যায় মাঠ-ঘাট, ঘড়-বাড়ি, গবাদি পশু, কোটি কোটি টাকার সম্পদ এতে বিনষ্ট হয়ে যায়।এছাড়া১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত বন্যায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ মার্কিন ডলারের সম্পদ হানি ঘটে।
২) উৎপাদন হ্রাস
বন্যা সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। বন্যার পানি হাজার হাজার হেক্টর ভূমির ফসল বিনষ্ট করে দেয়।এছাড়াও এ বন্যার পানি কলকারখানা, হাট-বাজার প্রভৃতি স্থানে প্রবেশের ফলে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। মানুষ ক্ষুদ্র পরিসরে যেসব উৎপাদন কর্মকান্ড পরিচালনা করে সেগুলোও এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
বন্যার প্রভাব দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। বন্যা ও বন্যা পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যায়। বন্যার পানিতে শাক-সবজি,চাল, ডাল প্রভৃতির ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উৎপাদন কমে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।
৪) উদ্বাস্তু সৃষ্টি
বন্যার পানিতে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ভেসে যায়। এছাড়াও বন্যার সময় মারাত্মকভাবে নদী ভাঙনের সৃষ্টি হয়। নদীর গর্ভে হাজার হাজার হেক্টর কৃষি জমি বিলীন হয়ে যায়। মানুষ ঘর-বাড়ি,জমি-জমা হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ বন্যার কারণে উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে।
৫) দরিদ্রতা বৃদ্ধি
বন্যার প্রভাব দরিদ্রতা বৃদ্ধির জন্য অনেকাংশে দায়ী। বন্যা ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধন করে। এছাড়াও বন্যার কারণে ফসল,ঘর-বাড়ি,গবাদিপশু প্রভৃতি হারিয়ে মানুষ দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী বন্যা পরবর্তী সময়ে নিজেদের পেশা ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারে না।
৬)অপরাধ বৃদ্ধি
বন্যার ফলে সম্পদের ক্ষতি,দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি,অভাব অনটন প্রভৃতির সৃষ্টি হয়। সাধারণ মানুষ নিজেদের পেশায় অনেক সময় ফিরে যেতে পারে না, যার ফলে নানাবিধ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে দেখা যায় যে, পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। সমাজে মাদক, চোরাচালান, ছিনতাই, সন্ত্রাসসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বৃদ্ধি পায়।
৭) শহরে জনচাপ বৃদ্ধি
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হয়ে পড়ে। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষ শহরে এসে ভিড় জমায়। ফলে শহরে জনচাপ বৃদ্ধি পায়।এর ফলে দেখা যায় শহরে বিভিন্ন অসামাজিক ও অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়।
৮) রোগ-ব্যাধির বিস্তার
বন্যার প্রভাব দ্রুত রোগ-ব্যাধির বিস্তার ঘটায়। বন্যার পানিতে বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী যেমন-গাছের ডাল, পাতা, লতা, খাদ্যদ্রব্য, মৃতদেহ, আবর্জনা প্রভৃতি পচে চারপাশের পরিবেশ দূষণ ঘটায়।এছাড়াও বন্যার সময় মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষ যত্রতত্র বসবাসের ফলে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। বন্যার সময় চোখ উঠা, ডায়রিয়া, কলেরা, নিউমোনিয়া প্রভৃতি রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
৯) আমদানি রপ্তানি ভারসাম্যহীনতা
বন্যার ফলে একটি দেশে কৃষি ও শিল্পসহ প্রায় সব ধরনের উৎপাদন ব্যাহত হয়।হাজার হাজার একর ফসল বিনষ্টের ফলে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়।খাদ্য চাহিদাসহ অন্যান্য চাহিদা মিটাতে একটি দেশকে অধিক খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে হয়। অপরদিকে, দেশীয় উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় রপ্তানি কমে যায়।ফলে আমদানি রপ্তানি ক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়।
১০) পারিবারিক ভাঙ্গন
বন্যার প্রভাব পারিবারিক ভাঙ্গন সৃষ্টি করে।বন্যার ফলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।এছাড়াও মানুষের চরম আর্থিক ক্ষতিসাধিত হয়। পরিবারের আপনজন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। অনেক মহিলা তাদের স্বামীকে হারিয়ে বিধবা হয়ে পড়ে।আবার পিতা-মাতাকে হারিয়ে অনেকে অসহায় হয়ে পড়ে।
১১) যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন
বন্যার ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বন্যার পানিতে রাস্তা-ঘাট প্লাবিত হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বন্যার সুফলের চেয়ে কুফলই বেশি।বন্যার কুফল সমূহ মানব জীবনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি সমগ্র প্রাণীজগতের জন্য দুঃখ-দুর্দশা বয়ে নিয়ে আসে। তাই বন্যা প্রতিরোধকল্পে জনগণ ও সরকারকে সম্মিলিত ভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।আজকের আর্টিকেলে বন্যার প্রভাব-বন্যার ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।