বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর

প্রিয়া পাঠক আপনারা কি জানেন বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।কারণ আজকের আর্টিকেলে বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের সংগঠিত বন্যার ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর
বাংলাদেশের বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয় অসংখ্য নদনদী।এদেশে ২৩০ টি ছোট বড় নদী রয়েছে।এ সকল নদী তীরবর্তী অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস

ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, সাইক্লোন, বন্যা বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই হয় (দৈনিক যুগান্তর,১৬ আগস্ট,২০০৭, পৃষ্ঠা ৫,ক-৪)।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশে বন্যা আঘাত হেনে আসছে।প্রতিবছর বাংলাদেশে কোথাও না কোথাও বন্যার সৃষ্টি হয়।বাংলাদেশে বন্যা ব্যাপকতা লাভ না করলে সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না এবং আলোচনায় আসেনা।প্রাচীনকালে বাংলাদেশে বন্যা সংঘটনের ঘটনা মহাভারত ও রামায়ণ থেকে জানা যায়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকেও বাংলাদেশের বন্যা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।


অধ্যাপক মহলানবীশ ১৯২৭ সালে একটি গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত বিভিন্ন বন্যার কারণ, প্রতিকার ও অন্যান্য বিষয় তুলে ধরেন।প্রতি বন্যায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যা সম্পর্কে তাই সর্বস্তরের মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষণার পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। ১,৪,৭,৫৭০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বাংলাদেশে ২৩০ টি ছোট বড় নদী রয়েছে।

এ সকল নদীর মোট দৈর্ঘ্য ২৪,১৩৫ কিলোমিটার।এ সকল নদীর ৯৩৮৪ বর্গ কিলোমিটার নদীবিধৌত এলাকার রয়েছে (BBS 1990)।বাংলাদেশে বন্যা সংঘটনের অন্যতম কারণ হলো নদী। এ সকল নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে সংঘটিত বন্যার ইতিহাস তুলে ধরা হলো:

১৯০২ সাল: ১৯০২ সালে সিলেটে বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যার ফলে ঘরবাড়ি ও ফসলের ক্ষতি হয়। নদীর পানি বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে এ বন্যা সংঘটিত হয়।

১৯০৪ সাল: ১৯০৪ সালে কক্সবাজার ও তীরবর্তী দীপাঞ্চলে বন্যা সংঘটিত হয়।সামুদ্রিক জোয়ারের ফলে এ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ বন্যার ফলে ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়।

১৯১৫ সাল: ১৯১৫ সালে ময়মনসিংহে বন্যা সংঘটিত হয়।

১৯২২ সাল: ১৯২২ সালে ময়মনসিংহে বন্যা সংঘটিত হয়।

১৯৫৪ সাল: ১৯৫৪ সালে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বন্যা সংঘটিত হয়।বছরের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর এবং ৩০ আগস্ট হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিকটে পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা ছিল যথাক্রমে ১৪.২২ মিটার এবং ১৪.১৯ মিটার।

১৯৫৫ সাল: ১৯৫৫ সালে ঢাকায় বন্যা সংঘটিত হয়।বুড়িগঙ্গা নদীর পানির বৃদ্ধির ফলে এ বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যার ফলে ঢাকা শহরের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

১৯৬২ সাল: ১৯৬২ সালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দুইবার বন্যা সংঘটিত হয়।

১৯৬৬ সাল: ১৯৬৬ সালে ঢাকা ও সিলেটে বন্যা সংঘটিত হয়। বন্যার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এই বন্যার ফলে জনজীবন চরণ ভাবে বিপর্যস্ত হয়। এ বন্যায় দেশে ৩৯ জন মানুষ এবং ১০ হাজার গবাদি পশু প্রাণ হারায়। একইভাবে ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়।

১৯৬৮ সাল: ১৯৬৮ সালে সিলেটে বন্যার সংঘটিত হয়। এই বন্যার ফলে ৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৬৯ সাল: ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রামে বন্যা সংঘটিত হয়।এ বন্যায় মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়।

১৯৭০ সাল: ১৯৭০ সালের সংঘটিত ঘূর্ণিঝড়ের ফলে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা একই সঙ্গে সংঘটিত হওয়ায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলে ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়।এছাড়াও এ বন্যায় গবাদি পশু, ফসলের মাঠ প্রভৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৭৪ সাল: ১৯৭৪ সালে ময়মনসিংহে বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যায় ১০,৩৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়। ব্যাপক এলাকা জুড়ে ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশু প্রভৃতি ক্ষতিসাধন করে।

১৯৮৭ সাল: ১৯৮৭ সালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বন্যা সংঘটিত হয়। এ বন্যায় দেশের ৪০% এর বেশি এলাকা প্লাবিত হয়।যার পরিমাণ ছিল ৫৭,৩০০ বর্গকিলোমিটার। ভারি বর্ষণের ফলে এ বন্যার সৃষ্টি হয়।

১৯৮৮ সাল: ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। এ বন্যায় দেশের ৫৩ টি জেলা প্লাবিত হয়।দেশের ৮৪,০৫৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় জুড়ে বন্যার পানি প্রবেশ করে।বন্যায় ৪ কোটি ৫ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২ মিলিয়ন হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার পানি ঢাকা শহরকে প্লাবিত করে।ফলে শহরের কর্মকাণ্ডে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এ বন্যা ১৫ থেকে ২০ দিন স্থায়ী হয়। ভয়াবহ এ বন্যার ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

১৯৮৯ সাল: ১৯৮৯ সালে সিলেট, সিরাজগঞ্জ ও মৌলভীবাজার জেলায় বন্যার সৃষ্টি হয়।এ বন্যায় ঘরবাড়ি ও ফসলে ক্ষতি সাধিত হয়।

১৯৯৩ সাল: ১৯৯৩ সালে দেশের ২৮ জেলায় বন্যা সংঘটিত হয়।এ বন্যার কারণ হিসেবে ভারী বর্ষণকে দায়ী করা হয়।

১৯৯৮ সাল: ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা সংঘটিত হয়। এটি ছিল বাংলাদেশে বিগত ৬০০ বছরের মধ্যে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা।বাংলাদেশে বন্যার জন্য দায়ী সকল কারণ এ সময়ে সক্রিয় ছিল। যার ফলশ্রুতিতে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়। ৯৮ সালের বন্যা সবচেয়ে দীর্ঘ স্থায়ী ছিল। তিন মাস বন্যার পানি সরেনি (দৈনিক যুগান্তর, ১৬ আগস্ট, ২০০৭, পৃষ্ঠা: ৮, ক-)।


এ সময়ে বন্যার পানি পুরো ঢাকা শহরকে প্লাবিত করে।ঢাকার সাথে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ কয়েক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের সৃষ্ট বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বেশি ছিল, যা দেশকে কয়েক দশক পিছিয়ে দেয়। ঢাকা শহরে বন্যার পানি প্রবেশের ফলে শহরের জীবন যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়। বন্যায় শহরের ৭০% এলাকা প্লাবিত হয়।শহরের শিল্প উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং এর ফলে অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলে।

২০০০ সাল: ২০০০ সালে বাংলাদেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সংঘটিত এ বন্যা ছিল বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সংঘটিত সবচেয়ে বড় বন্যা। বন্যায় ফসল ও গবাদিপশু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বন্যায় ৩০ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে।

২০০৪ সাল: ২০০৪ সালে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের জেলাসমূহে বন্যার সৃষ্টি হয়। এ বন্যায় দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যবর্তী অঞ্চলসমূহ প্লাবিত হয়। ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলায় বন্যার পানি প্রবেশের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বহু সংখ্যক শিল্প- কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।এ বন্যায় ফসলের তুলনায় শিল্প কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

২০০৭ সাল: ২০০৭ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়।বছরের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ হতে বন্যার পানি বৃদ্ধি পায়।দীর্ঘদিন অবস্থানের পরে বন্যার পরিস্থিতির অবসান ঘটে।বর্ষা মৌসুমে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে এ বন্যার সৃষ্টি হয়।ভারি বর্ষণের ফলে সৃষ্ট চীন ও ভারতের পানি ভাটির পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

২০০৮ সাল: ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ব্যাপক ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। এ বন্যায় জান ও মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি নোয়াখালী, ফেনী ও কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জায়গায় বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে।

২০১৭ সাল: ২০১৭ সালে সিলেট ও সুনামগঞ্জসহ প্রায় ২০ টি জেলায় বন্যার যে ভয়ঙ্কর রূপ দেখা গেছে তা প্রায় দেড়শ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বলে মনে করা হয়।এ বন্যায় সড়ক, মহাসড়ক, কালভার্ট, বেড়িবাঁধ, রেললাইন, বিদ্যুৎ ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়।

২০২২ সাল: ২০২২ সালে বাংলাদেশে ব্যাপক বন্যা দেখা যায়।এ বন্যায় দেশের সিলেট,সুনামগঞ্জ এবং মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জ ও উত্তর অঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলা প্লাবিত হয়।২০২২ সালের এ বন্যায় সিলেট বিভাগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।সিলেট বিভাগের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করেছিল। সিলেটে ক্ষয় ক্ষতির মাত্রাও ছিল অনেক বেশি।

২০২৪ সাল: ২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে মারাত্মক বন্যা এবং ভূমিধসের ঘটনা ঘটে।এছাড়াও জুন ও পরবর্তী মাসের ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে পূর্ব বাংলাদেশ এবং ভারতের আসাম রাজ্যে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সেটা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।


এ ভয়াবহ বন্যায় বাংলাদেশের প্রায় ১১ টি জেলায় ৮ লাখ ৮৭ হাজার ৬২৯ টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫৪ লাখ।এ বন্যায় মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণীর ব্যাপক প্রাণ হানি ঘটে। এ বন্যায় প্রায় ১০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। এছাড়াও রাস্তাঘাট ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, বাংলাদেশে যত বন্যা হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ধ্বংসাত্মক বন্যা হয় ১৯৮৮, ১৯৯১,১৯৯৮, ২০২২ ও ২০২৪ সালে। বন্যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতিসাধন করে চলেছে।এছাড়াও দেখা যায় যে বন্যার আঘাতে দেশের সমাজ ও অর্থনীতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশে বন্যার ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url