নদী ভাঙ্গন কি-নদী ভাঙ্গনের কারণ-নদী ভাঙ্গনের প্রভাব
নদী ভাঙ্গন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। সাধারণ অর্থে নদী ভাঙ্গন বলতে নদীর পানি প্রবাহের ফলে নদীর তীর বা পাড়ের ভাঙ্গনকে বোঝায়।সমগ্র বিশ্বে নদী ভাঙ্গন একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত। সাধারণত ভাবে বর্ষা মৌসুমে নদীতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়।আজকের আর্টিকেলে নদী ভাঙ্গন কি-নদী ভাঙ্গনের কারণ-নদী ভাঙ্গনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
নদী ভাঙ্গনের ফলে আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশের উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে।এই নদী ভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছর বিশ্বে উদ্বাস্তু জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভূমিকা
বিশ্বায়নের যুগে এসে দেখা যায় যে, মানুষ যখন নিত্য নতুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে জীবনকে অর্থবহ এবং ভোগবিলাসিতার প্রাচুর্যে ভাসিয়ে দিচ্ছে সেখানে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর এবং নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে যাচ্ছে। নদী ভাঙ্গন এরূপ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ,যা দরিদ্র বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে।
আরো পড়ুন:নদীর সংজ্ঞা দাও-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয়
নদী ভাঙ্গনের ফলে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। জাতীয় অর্থনীতি হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। পৃথিবীর সকল নদীমাতৃক দেশে নদী ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটে। উন্নত বিশ্বের নদী ভাঙ্গনের মাত্রা বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কমিয়ে আনা হয়।কিন্তু দারিদ্র্য ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহে এর ভয়াবহ রূপ ফুটে উঠে। মানুষ সবকিছু হারিয়ে দুস্থ, নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে।
নদী ভাঙ্গন কি?
নদী ভাঙ্গন একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। সাধারণ অর্থে নদী ভাঙ্গন বলতে নদীর পানি প্রবাহের ফলে নদীর তীর বা পাড়ের ভাঙ্গনকে বুঝায়।এ ভাঙ্গন নদীর তীরবর্তী বাড়ি-ঘর, কৃষি ভূমি, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট,অফিস-আদালত, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, বনভূমি প্রভৃতি নদীগর্ভে বিলীন করে দেয়। সমগ্র বিশ্বে নদী ভাঙ্গন একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে পরিচিত।সাধারণভাবে বর্ষা মৌসুমে নদীতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়।
আরো পড়ুন:বাংলাদেশের নদ-নদীর একটি বিবরণ দাও
নদী ভাঙ্গনের আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। প্রতিবছর এটি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে সমগ্র বিশ্বে উদ্বাস্তু জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি করে চলেছে।বিশ্বের দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশসমূহে নদী ভাঙ্গন রোধের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। ফলে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়ে উঠে না।
নদী ভাঙ্গনের কারণ
নদী ভাঙ্গন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে কতগুলো প্রাকৃতিক কারণে এটি সংঘটিত হয়। মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডকেও এর জন্য দায়ী করা হয়। নদী ভাঙনের কারণ সমূহকে দুই ভাগে আলোচনা করা যায়।যথা-
ক) প্রাকৃতিক কারণ
খ) মনুষ্য সৃষ্ট কারণ
ক) প্রাকৃতিক কারণ
নদী ভাঙ্গনের প্রাকৃতিক কারণসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১) নদীর গতিপথ পরিবর্তন
প্রাকৃতিক নিয়মে (যেমন ভূমিকম্পের ফলে) নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করে। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়। নদী তার পূর্বের গতিপথ পরিবর্তন করে যে নতুন গতিপথ গ্রহণ করে তার সমগ্র এলাকা নদীগর্ভে চলে যায়। তাই দেখা যায় যে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে নদী ভাঙ্গনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে।
২) নদীতে পলি জমা
নদী ভাঙ্গনের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয় নদীতে পলি জমা। নদীতে পানি প্রবাহের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে নদীর তলদেশে পলি জমা হয়। বছরের পর বছর ধরে নদীর তলদেশ পলি জমে ভরাট হয়ে যায়। ফলে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। স্বাভাবিক পানি ধারণ ক্ষমতা না থাকলে নদীর দু'কূলে পানির চাপ বৃদ্ধি পেয়ে ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়।
৩) প্রবাহিত বৃষ্টিপাতে
বৃষ্টির পানি বিভিন্ন মাধ্যমে নদীতে গিয়ে মিশে যায়। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদীতে অধিক পানি প্রবাহিত হয়। আবার কোন কোন বর্ষা মৌসুমে অধিক বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটে। বর্ষা মৌসুমে কয়েক মাস ধরে নদীতে অধিক মাত্রায় পানি প্রবাহিত হয়। দীর্ঘ সময় ধরে নদীতে অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে নদী ভাঙ্গন ঘটে।
৪) নদী তীরের মাটির প্রকৃতি
দেখা যায় যে নদী তীরের মাটির প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি হয়।নদী তীরের মাটিতে এঁটেলের পরিমাণ বেশি থাকলে নদী ভাঙ্গন কম হয়। অন্যদিকে নদী তীরের মাটিতে বেলে মাটির পরিমাণ বেশি হলে নদী ভাঙ্গন বেশি হয়।
৫) বন্যা
বন্যার ফলে নদীরসমূহ অধিক পানি প্রবাহ ঘটায়। এছাড়াও বন্যার পানি নদীর তীরবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে এসব প্লাবিত এলাকায় নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে।
খ) মনুষ্য সৃষ্ট কারণ
নদী ভাঙ্গনের জন্য অনেকাংশে দায়ী মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ড। নদী ভাঙ্গনের মনুষ্য সৃষ্ট কারণ সমূহ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
১) নদী তীরের গাছপালা কাটা
গাছপালা মাটিতে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে। নদী তীরে গাছপালা থাকলে নদীর ঢেউ ভাঙ্গনের সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু নদী তীর থেকে গাছপালা কেটে ফেলার ফলে নদীর ঢেউ কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয় না, যা নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে।
২) নিয়মিত নদী খনন না করা
নদীতে পানি প্রবাহের ফলে এর তলদেশে পলি জমা হয়। পলি জমা হয়ে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এ জন্য নদীতে পলির পরিমাণ কমানোর জন্য নিয়মিত নদী খনন করতে হয়।নিয়মিত নদী খনন করা না হলে পলি জমে ভরাট হয়ে যায়, যা নদী ভাঙ্গন ঘটায়।
৩) অধিক হারে নৌযান চলাচল
নৌযানসমূহ চলাচলের সময় নদীতে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এ ঢেউ নদীর তীরে আঘাত হেনে নদী ভাঙ্গন ঘটায়। অধিক হারে নৌযান চলাচলের ফলে নদীতে অধিক ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়, যা ফলশ্রুতিতে নদী ভাঙ্গনের সৃষ্টি করে।
নদী ভাঙ্গনের প্রভাব/ফলাফল
নদী ভাঙ্গনের ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, কৃষি ভূমি প্রভৃতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।সবকিছু হারিয়ে মানুষ হয়ে পড়ে নিঃস্ব।আর্থ-সামাজিক জীবনে নদী ভাঙ্গন সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে।নদী ভাঙ্গনের আর্থ-সামাজিক প্রভাবসমূহ হলো:
১)সম্পদ হানি
নদী ভাঙ্গনের ফলে ব্যাপক সম্পদ হানি ঘটে। ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, কৃষি ভূমিসহ বিভিন্ন সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে সেগুলো পুনরুদ্ধার করা যায় না। মানুষ চিরকালের জন্য সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। এভাবে নদী ভাঙ্গনের ফলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ হানি হয়।
২) উদ্বাস্তু সৃষ্টি
নদী ভাঙ্গনের ফলে মানুষ ঘর-বাড়ি ও জমিজমা হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়।বিশ্বব্যাপী নদী ভাঙ্গন উদ্বাস্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি করে। এ সমস্ত উদ্বাস্তু জনগণ ভাসমান জীবন যাপনে বাধ্য হয়।
৩) দারিদ্র্য বৃদ্ধি
নদীগর্ভে সম্পদ বিলীন হয়ে গেলে সাধারণ মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে যায়।সমাজে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও দেখা যায় যে,নদী তীরবর্তী জনগণ তাদের জমিজমা হারিয়ে উৎপাদন থেকে বিচ্যুত হয়।ফলে তারা দারিদ্র্য পর্যবসিত হয়।
৪) উৎপাদন হ্রাস
নদী ভাঙ্গনের ফলে কৃষি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। আবার তেমনি নদীর তীরবর্তী শিল্প-কারখানাও এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি জমি ও শিল্প-কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়।
৫) দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি
নদী ভাঙ্গন ব্যাপকভাবে উৎপাদন হ্রাস করে। এর ফলে দ্রব্যের সরবরাহ হ্রাস পায়।পরিণাম স্বরূপ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়।
৬) সামাজিক বন্ধনে ভাঙ্গন সৃষ্টি
নদী ভাঙ্গনের ফলে মানুষ বসতভিটা হারিয়ে নতুন স্থানে গমন করে। এর ফলে মানুষ আত্মীয়-পরিজন থেকে অনেক দূরে সরে যায়।ফলে সমাজে বিবাহ-বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পায়।
৭) অপরাধ বৃদ্ধি
নদী ভাঙনের ফলে মানুষ একদিকে যেমন বাস্তুচ্যুত হয়ে যায়, তেমনি চরম দারিদ্র্য পর্যবসিত হয়। বাস্তবহীন এ দরিদ্র জনগোষ্ঠী শহরে বা গ্রামে সর্বত্র বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। সমাজে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক চোরাচালান, পতিতাবৃত্তিসহ বিভিন্ন অপরাধ বৃদ্ধি পায়।অসহায় মানুষ জীবনধারণের জন্য এসব অপরাধমূলক কার্যকলাপে অংশগ্রহণে বাধ্য হয়।
৮) শহরে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি
গ্রামের তুলনায় শহরে কাজের সুযোগ সুবিধা বেশি। নদী ভাঙ্গন প্রবন এলাকার মানুষ বাস্তুভিটা হারিয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে শহরে পাড়ি জমায়। দলে দলে মানুষ শহরে চলে আসার ফলে শহরে জনচাপ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শহরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
৯) রোগ-ব্যাধির বিস্তার
নদী ভাঙ্গনের শিকার জনগণ রাস্তা, ফুটপাত, বাঁধসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাসে বাধ্য হয়। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করার ফলে তারা স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা পায় না। পরিনামস্বরূপ তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। ফলে তারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।
১০) পুষ্টিহীনতা
বিশ্বের যে দেশ বা অঞ্চলে নদী ভাঙ্গন দেখা দেয়। আর সেই অঞ্চলে এই নদী ভাঙ্গনের ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পায় এবং পরিণামস্বরূপ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়।সাধারণ মানুষের আয় উপার্জনও কমে যায়। তাই তারা পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করতে পারে না। ফলে জনগণ পুষ্টিহীনতাই ভোগে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, নদী ভাঙ্গন একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলো বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল নদীমাতৃক দেশে নদী ভাঙ্গনের ঘটনা ঘটে। আজকের আর্টিকেলে নদী ভাঙ্গন কি-নদী ভাঙ্গনের কারণ-নদী ভাঙ্গনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।