নদীর সংজ্ঞা দাও-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয়

নদীর সংজ্ঞা বলতে বোঝায়, উচ্চভূমি এলাকায় বরফ গলা পানি, বৃষ্টি, অভিস্রবণ, প্রস্রবণ প্রভৃতির ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতধারা সৃষ্টি হয় এবং এদের মিলিত রূপই হলো নদী।কোন জলধারা যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূমির ঢাল বরাবর একটি খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোন বড় জলাশয় বা সাগরে পড়ে, তখন সেই পানিস্রোতকে নদী বলে। আজকের আর্টিকেলে নদীর সংজ্ঞা-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।

নদীর সংজ্ঞা দাও-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয়
কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বহুলাংশে নির্ভর করে সে দেশের নদ-নদীর উপর। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায়ের ক্ষেত্রে নদ-নদীর গুরুত্ব অধিক। নিম্নে নদীর সংজ্ঞা দাও-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয় তা বর্ণনা দেওয়া হল:

ভূমিকা

পর্বত, মালভূমি কিংবা যে কোনো উচ্চভূমি থেকে হিমবাহ গলন, বৃষ্টির পানি প্রস্রবণ, অভিস্রবণ বা যে কোনো উৎস থেকে পানি নিম্ন ঢাল বরাবর প্রবাহিত হয়ে হ্রদ, সাগর বা মহাসাগরে পতিত হলে তাকে নদী বলা হয়। সাধারণ উচ্চভূমি অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলধারা একত্রে মিলিত হয়ে সুবৃহৎ ও গভীর খাত সৃষ্টি করে নিম্ন ঢালের দিকে প্রবাহিত হয়। উচ্চ ভূমির এসব জলধারার যেটি সবচেয়ে সর্বপ্রধান তাকে নদীর উৎস বলা হয়।


উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গঙ্গা নদীর উৎসস্থল হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ।ঐ হিমবাহ গলনে সৃষ্ট মূল স্রোতধারার সাথে চতুর্দিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলরাশি এসে স্রোতধারাকে শক্তিশালী করে।নদী যে স্থানে সমুদ্র বা হ্রদে মিলিত হয় তাকে মোহনা বলে (Mouth of the river)। যে সমস্ত নদীর আকৃতির একটি মাত্র মুখ সমুদ্রের দিকে অধিক বিস্তৃত থাকে তাকে খাড়ি (Estuary)বলে। বাংলাদেশের মেঘনা নদী ও বৃটেনের টেমস নদীর খাড়ি বিখ্যাত।

নদীর সংজ্ঞা

নদীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বাংলায় একটা কথা মনে হয়, "পানি দাঁড়ালেই পুকুর, গড়ালেই নদী"। অর্থাৎ বন্ধ পানি পুকুর, প্রবাহমান পানি নদী। ভূগোল শাস্ত্র মতে, কোন জলধারা যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূমির ঢাল বরাবর একটি খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কোন বড় জলাশয় বা সাগরে পড়ে, তখন সেই পানিস্রোতকে নদী বলে।মেরি মরিসাওয়া (Mary Morisawa) নদীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- A stream may be defined as a channelised flow of water."অর্থাৎ শ্রীমতী মরিসাওয়ার মতে, খাতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলধারাকে নদী বলে।

পানি বিজ্ঞানী Jackie Smith বলেন, নদী হল, 'A large stream of fresh water flowing downhill within a channel to enter another river,or a lake or sea' অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট খাতের মধ্য দিয়ে নিম্ন ঢালের দিকে প্রবাহিত এবং সমুদ্র,হ্রদ অথবা অন্য কোন নদীতে পতিত সুপেয় পানির বৃহৎ জলাধার কে নদী বলে।মরু অঞ্চলের নদী খাতগুলো বছরে প্রায় বেশিরভাগ সময়ের শুকনো থাকে। বছরে অল্প কিছুদিন এদের মধ্যে দিয়ে পানি প্রবাহিত হতে দেখা যায়। এরূপ স্বল্পকালীন জলধারা আরব দেশে ওয়াদি(Wadi), যুক্তরাষ্ট্রে অ্যারোয়া (Arroya), ভারতে নালা(Nullah) নামে পরিচিত।

যেসব প্রাকৃতিক শক্তি ভূমিরূপ গঠনের ক্ষেত্রে সরাসরি অংশগ্রহণ করে তাদের মধ্যে নদী এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।মরু অঞ্চলে অবশ্য সময় বিশেষে জলাধারার কার্যের প্রভাবে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তবে মেরু অঞ্চল ব্যতীত ভূপৃষ্ঠের প্রায় সকল অঞ্চলেই নদীর কার্য লক্ষ্য করা যায়। সাধারণত পার্বত্য অঞ্চল অথবা উচ্চ মালভূমি থেকে সৃষ্ট ঝর্ণা প্রস্রবণ,হিমবাহ বা তুষার গলা পানি নিম্নদিকে প্রবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট খাত পথে সমুদ্রে বা হ্রদে পতিত হয়। এই জলধারাকে বলে নদী।


পাহাড়, পর্বত, হ্রদ, হিমবাহ প্রভৃতির জলধারা একত্রে মিলিত হয়ে একটি নদীর সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে যেটি সর্বপ্রথম সৃষ্টি হয় তাকে নদীর উৎস বলা হয়। তবে নদীর সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায় যে বৃষ্টিপাত বা তুষার গলা পানি ভূমির ঢালকে অনুসরণ করে প্রবাহিত হলে ভূপৃষ্ঠের অপেক্ষাকৃত নিচু অংশে একত্রিত হয়ে অসংখ্য rill বা অনুখাতের সৃষ্টি করে। এই সকল অনুখাতের আকৃতি ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে বৃহত্তম খাত বা Gully এর সৃষ্টি করে। পানি পরবর্তী সময়ে এই সকল খাতগুলো একত্রিত হয়ে বড় আকারের খাতে পরিণত হলে তখন তাকে নদী খাত বলা হয়।

নদী কিভাবে সৃষ্টি হয়

উচ্চভূমি এলাকায় বরফ গলাপানি,বৃষ্টি,অভিস্রবণ, প্রস্রবণ প্রভৃতির ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোতধারা সৃষ্টি হয় এবং এদের মিলিত রূপই হলো নদী। প্রকৃতপক্ষে উচ্চভূমি এলাকায় প্রথমে ক্ষুদ্র স্রোতধারা সৃষ্টি হয় যা Rill (রিল) হিসেবে আখ্যায়িত। পরবর্তীতে একাধিক রিল মিলিত হয়ে সুগভীর ক্ষুদ্র খাত বা গালি (Gully) তৈরি করে। দুই বা ততোধিক গালি মিলিত ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী বা প্র-উপনদী তৈরি করে পরবর্তীতে আরো বৃহৎ স্রোতস্বিনী বা উপনদী এবং সর্বশেষ প্রধান নদী সৃষ্টি হয়।


তবে একটি প্রধান নদীতে একাধিক উপনদী ও প্র-উপনদী থাকতে পারে। আবার পার্বত্য এলাকায় প্রধান নদীতে প্রচুর রিল ও গালি পতিত হয়ে নদীর প্রবাহ বৃদ্ধি করে। তবে প্রধান নদী খাত কয়েকটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়। ভূমিরূপ বিজ্ঞানী স্ট্রলারের মতে চারটি পর্যায় এবং হর্টনের মতে পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে নদী বিকশিত হয়।হর্টনের মতে ক্ষুদ্রতম স্রোতধারাকে বলা হয় প্রথম পর্যায়ের নদী।

দুই বা ততোধিক প্রথম পর্যায়ের স্রোতধারা মিলিত হয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী এবং একাধিক দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী বা স্রোতধারা মিলে তৃতীয় পর্যায়ের নদী সৃষ্টি করে। এইভাবে চতুর্থ বা পঞ্চম পর্যায়ে প্রধান নদী খাত বা নদী প্রবাহ সৃষ্টি হবে।হর্টনের মতে, বিভিন্ন পর্যায়ের স্রোত ধারাগুলো জ্যামিতিক হারে পরিবর্তিত হয় এবং তা স্থির বিভাজিত অনুপাতে বৃদ্ধি পায়। সমস্ত পর্যায়ের স্রোতধারা মিলিত হয়ে উচ্চতম পর্যায়ের নদী সৃষ্টি হয় যা'প্রধান নদী হিসেবে পরিচিত এবং এরপর আর কোন পর্যায়ের সৃষ্টি হয় না।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, উঁচু পর্বত বা মালভূমি থেকে বৃষ্টি, প্রস্রবণ, হিমবাহ বা বরফ গলা পানিতে সৃষ্ট কোন জলধারা যখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূমির ঢাল বরাবর প্রবাহিত হয়ে সমভূমি ও নিম্ন ভূমির উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে অবশেষে কোন বিশাল জলাশয় বা হ্রদ অথবা সমুদ্রে পতিত হয়, তখন তাকে নদী বলা হয়। আজকের আর্টিকেলে নদীর সংজ্ঞা-নদী কিভাবে সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url