বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ দাও

প্রিয় পাঠক আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। কারণ খনিজ সম্পদ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান চাবিকাঠি। যে দেশ খনিজ সম্পদে যত সমৃদ্ধ, অর্থনৈতিক দিক থেকে সে দেশ তত উন্নত। কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে খনিজ সম্পদের ভূমিকা অপরিসীম।
বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ দাও
এছাড়া স্বাধীনতা উত্তরকালে বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ অনুসন্ধানে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় এদেশে প্রচুর খনিজ সম্পদ মজুদ রয়েছে। তাই বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ তুলে ধরা হলো:

ভূমিকা

ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরভাগের শিলা স্তরের মাটি খনন করে যে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা হয় তাকে খনিজ সম্পদ বলে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও দেখা যায় যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে খনিজ সম্পদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ নয়।অথচ দেশের শিল্পোন্নয়নে এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক কাজে খনিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে বাংলাদেশে বর্তমানে বেশ কিছু খনিজ সম্পদ আবিষ্কৃত হয়েছে যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের খনিজ সম্পদ

বাংলাদেশে অধাতব ও ধাতব উভয় ধরনের খনিজ সম্পদ রয়েছে।বাংলাদেশে প্রাপ্ত প্রধান খনিজ সম্পদ গুলো হচ্ছে, কয়লা, খনিজ তেল, চুনাপাথর, চীনামাটি, তামা, কঠিন শিলা, সিলিকা বালি, পারমাণবিক খনিজ পদার্থ, লবণ, গন্ধক, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি।এদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস এ দেশে সমৃদ্ধ। এদেশে যেসব খনিজ সম্পদ পাওয়া গেছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো:

খনিজের উৎস মূলত দুই প্রকার

ক) জৈবিক খনিজ: কয়লা, গ্যাস, তেল

খ) অজৈবিক খনিজ: অধাতব, ধাতব

ক) জৈবিক খনিজ:

১) কয়লা

ইন্দন শক্তি হিসাবে কয়লার গুরুত্ব অপরিসীম।১৯৫৯ সালে স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাকুয়াম অয়েল কোম্পানি বগুড়ার কুচমায় তেল অনুসন্ধানের সময় প্রায় ৩ হাজার মিটার গভীরে কয়লা আবিষ্কার করে।পরবর্তী সময়ে দেখা যায় জামালগঞ্জে প্রায় ১০০ মিটার গভীরে কয়লা আবিষ্কৃত হয়। এখানকার কয়লার স্তর ১০.৩৬ কিলোমিটার স্থান ব্যাপী বিস্তৃত এবং সঞ্চয় এর পরিমাণ প্রায় ১০০ কোটি টন। এছাড়াও দিনাজপুরের বড় পুকুরিয়া নামক স্থানেও কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে।


সিলেটের লামাকাটা ভাঙ্গারঘাট এলাকায় কয়লার পরিমাণ প্রায় ৩০ লক্ষ টন। বাংলাদেশের উৎপাদিত কয়লার মান অত্যন্ত নিম্ন। তবে সম্প্রতি বাংলাদেশে কিছু উন্নত মানের বিটুমিনাস ও লিগনাইট কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব খনি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ, জয়পুরহাট, বগুড়া, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, রংপুর প্রভৃতি জেলায় অবস্থিত।

এছাড়া ফরিদপুরের বাঘিয়া, চান্দা বিল ও জলিরপাড়, খুলনার কোলা বিল এবং সিলেটের পিট জাতীয় কয়লা আবিষ্কৃত হয়েছে।বর্তমানে ফরিদপুর ও খুলনা থেকে যথারীতি কয়লা উত্তোলিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাংলাদেশে যে পরিমাণ কয়লা সঞ্চিত আছে তা উত্তোলন করতে পারলে আগামী ২০০ বছর পর্যন্ত তা ব্যবহার করা সম্ভব হবে। কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক অসুবিধা ও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক নয় বিধায় এগুলো উত্তোলন করা হচ্ছে না।

২) প্রাকৃতিক গ্যাস

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ। ১৯৫৫ সালে সিলেটের হরিপুরে সর্বপ্রথম প্রাকৃতিক গ্যাসের সন্ধান পাওয়া যায়। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ২৩ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে।এ সকল খনিগুলোতে উত্তোলনযোগ্য প্রমাণিত গ্যাসের পরিমাণ প্রায় ১৫. ১৯ ট্রিলিয়ন ঘনফুট এবং সম্ভাব্য ক্যাটাগরিতে ৫. ২৮ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। বর্তমানে ১৬ টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৬৭ টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। এসব গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, বাণিজ্যিক, শিল্প ও গৃহস্থালির জ্বালানির প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস অন্যতম

৩)খনিজ তেল

১৯১০ সাল থেকে এদেশে খনিজ তেল অনুসন্ধান শুরু হয়। বিভিন্ন বিদেশী কোম্পানি বিভিন্ন সময়ে দেশের কতিপয় স্থানে খনন কার্য চালিয়ে তেল আবিষ্কারে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে যায়। অবশেষে ১৯৮৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলা সিলেটের হরিপুরে তেল আবিষ্কার করে।এ তেলক্ষেত্রে তেলের মোট মজুদের পরিমাণ প্রায় ১০ মিলিয়ন ব্যারেল যার মধ্যে উত্তোলনযোগ্য মজুদের পরিমাণ প্রায় ৬ মিলিয়ন ব্যারেল।


১৯৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে হরিপুর তেলক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদন শুরু হয়। উৎপাদন শুরুর পরবর্তী সাড়ে ছয় বছরে এ তেলক্ষেত্র থেকে মোট ০. ৫৬ মিলিয়ন ব্যারেল খনিজ তেল উৎপাদন করার পর ১৯৯৪ সালের জুলাই মাস থেকে তেল উৎপাদন স্থগিত হয়ে যায়। কৈলাসটিলা ও ফেঞ্চুগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে আরো দুটি তেলবাহী শিলা স্তরের সন্ধান পাওয়া গেলেও অর্থনৈতিক ভাবে এ দুটি ক্ষেত্র থেকে তেল উৎপাদন লাভজনক হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সম্পূর্ণ জরিপকার্য পরিচালনা করা হয়নি।

সাম্প্রতিকালে দেশে একাধিক সংখ্যক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি হাইড্রোকার্বন অনুসন্ধানে নিয়োজিত রয়েছে। দেখা যায় এসব কোম্পানির স্বার্থে পেট্রোবাংলার আওতাভুক্ত এবং দেশের একমাত্র তেল-গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান বাপেক্স' সফলভাবে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে নিয়োজিত রয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে খনিজ তেল অন্যতম।

খ) অধাতব খনিজ:

১) চুনাপাথর

বাংলাদেশ চুনাপাথরে সমৃদ্ধ। সিলেট, সুনামগঞ্জ, জয়পুরহাট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রচুর চুনাপাথর সঞ্চিত রয়েছে। অনুমিত সঞ্চয়ের পরিমাণ ১৪. ৭৬ কোটি মেট্রিক টন। সিমেন্ট, ইস্পাত, ব্লিচিং পাউডার, কাঁচ,সাবান, কাগজ, চিনি, রং প্রভৃতি তৈরিতে চুনাপাথর ব্যবহার করা হয়।

২) চীনামাটি

নেত্রকোনা জেলার বিজয়পুরে, নওগাঁ জেলার পত্নী তলায়, শেরপুর জেলার ভুরুঙ্গায় এবং চট্টগ্রাম জেলার হাইটগাঁও, কাঞ্চনপুর ও এলাহাবাদে চীনামাটির সন্ধান পাওয়া গেছে। বাসনপত্র, বৈদ্যুতিক ইনস্যুলেটর, কাগজ ও রাবার শিল্পে চীনামাটি ব্যবহার করা হয়।২০০৪-০৫ অর্থ বছরে বাংলাদেশে চীনামাটি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৩.৭৪ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে চিনা মাটি উৎপাদিত হয়েছে ১৯.৭৭ হাজার মেট্রিক টন।

৩) সিলিকা বালি

বাংলাদেশের শেরপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে ও ময়মনসিংহের বালিজুরি জেলায় সিলিকা বালু পাওয়া গেছে। আর এসব স্থানে সিলিকা বালির আনুমানিক সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রায় ৩৫.৫০ লক্ষ মেট্রিক টন।২০০০-০১ সালে বাংলাদেশে সিলিকা বালি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১.৮৩ লক্ষ ঘনফুট।

৪) খনিজ বালি

চট্টগ্রাম জেলার কুতুবদিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর খনিজ বালি পাওয়া গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে খনিজ বালু অন্যতম। এতে প্রচুর ভারী খনিজ পদার্থ বিদ্যমান। এই খনিজ বালি নিউক্লিয়ার রিয়াক্টরের জ্বালানি, রঙিন টেলিভিশন ও ভারী ধাতব শিল্পে ব্যবহৃত হয়।২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে খনিজ বালি উৎপাদিত হয় ৪.১৭ লক্ষ মে.টন।

৫) কঠিন শিলা

রংপুর জেলার রানিপুকুর ইউনিয়নের লালপকুর এবং দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর থানার মধ্যপাড়ায় কঠিন শিলার সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়াও সিলেটের ভোলাগঞ্জে কঠিন শিলা পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ১৬ লক্ষ মেট্রিক টন।দালান,রাস্তা, ব্রিজ,বাঁধ ও বিভিন্ন প্রকার নির্মাণ কাজে কঠিন শিলা ব্যবহৃত হয়।

৬) নুড়ি পাথর

বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের মধ্যে নুড়ি পাথর অন্যতম। কারণ বাংলাদেশের সিলেট জেলার লুবা,ভোলাগঞ্জ ও পিয়নগঞ্জসহ দিনাজপুর,পঞ্চগড় এবং লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম নামক স্থানে প্রচুর পরিমাণ নুড়ি পাথর পাওয়া গেছে। দেশে এর সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রায় ৯.৭৫ কোটি মেট্রিক টন।

৭) লবণ

বাংলাদেশে কোন লবণের খনি নেই। দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে সমুদ্রের লোনা পানি আবদ্ধ করে প্রচুর লবণ প্রস্তুত করা হচ্ছে। বাংলাদেশে এর বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১০.৯৫ কোটি মেট্রিক টন।

৮) গন্ধক

বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কুতুবদিয়ায় গন্ধকের সন্ধান পাওয়া গেছে। অর্থনৈতিকভাবে এটি উত্তোলন করা অলাভজনক বিধায় এখনো উত্তোলন করা হচ্ছে না।

গ)ধাতব খনিজ:

১)তামা

বাংলাদেশের রংপুর জেলার রানী পুকুরে কঠিন শিলা স্তরে সামান্য তামা পাওয়া গেছে। এছাড়া দিনাজপুর জেলার মধ্যপাড়ায় ও রংপুরের পীরগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকার ভূগর্ভে আগ্নেয়শিলার সাথে তামা আবিষ্কৃত হয়েছে।এসব খনি থেকে সরকার তামা উত্তোলনের চেষ্টা চালাচ্ছে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি, বাসনপত্র, মুদ্রা প্রভৃতি তৈরি করতে তামা ব্যবহৃত হয়।

২)আকরিক লৌহ

সিলেট, ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামে নিম্নমানের আকরিক লোহা পাওয়া গেছে। যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্য পর্যন্ত সকল কিছুতে এই আকরিক লৌহের ব্যবহার সর্বাধিক।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, খনিজ সম্পদে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ নয়। তবুও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত খনিজ সম্পদ গুলোর উত্তোলন ও সদ্ব্যবহার সম্ভব হলে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা সচল হবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। সুতরাং এদেশ খনিজ সম্পদে যত সমৃদ্ধ হবে তত বেশি শিল্প গড়ে উঠবে এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়েও দেশ তত বেশি উন্নত হবে। আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের খনিজ সম্পদের বিবরণ বিস্তারিতভাবে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url