রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা নানা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আজকের আর্টিকেলে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো
রসুনকে বলা হয় প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক। রসুন দৈনন্দিন খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বিশেষজ্ঞদের মতে, হার্টের নানা সমস্যা সমাধানে কাঁচা রসুনের গুরুত্ব অধিক। এছাড়াও রসুন নানারকম জটিল রোগ সারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সুতরাং রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো।

ভূমিকা

অতি প্রাচীনকাল থেকে রান্নার কাজে অন্যান্য মসলার পাশাপাশি রসুন ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রসুন তরকারির স্বাদকে দ্বিগুণ করে। রসুন সাধারণত রান্নার কাজে ব্যবহৃত হলেও প্রাচীনকাল থেকে এটা ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রসুনে রয়েছে নানা পুষ্টি উপাদান। নানা গবেষণায় দেখা গেছে যে কাঁচা রসুন স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী। বিশেষ করে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দূর করতে কাঁচা রসুনের জুরি নেই। রসুন ভাজলে বা রান্না করলে তাপে এটার প্রধান রাসায়নিক উপাদান অ্যালিসিনের গুনাগুন নষ্ট হয়ে যায়। তবে রসুনের আচার খেলে জীবাণুনাশক গুন পাওয়া না গেলেও অন্যান্য উপকারিতা পাওয়া যাবে।

আরো পড়ুন:পেঁয়াজের উপকারিতা ও অপকারিত-পেঁয়াজের পুষ্টিগুণ

রসুনের পুষ্টি উপাদান

নানা পুষ্টি উপাদানে ভরপুর বলে রসুনকে সুপার ফুড নামে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অতি প্রাচীন কাল থেকে রোগ মুক্তির জন্য রসুন ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, বিশেষ করে মিশরীয়, ব্যাবিলনীয়, গ্রিক, রোমান ও চৈনিক সভ্যতায়। এছাড়াও চীন ও ভারতে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা জন্য কাঁচা রসুনের ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকে দেখা যায়। রসুনের কয়েকটি পুষ্টি উপাদান তুলে ধরা হলো:
  • শর্করা,
  • স্নেহ পদার্থ,
  • প্রোটিন,
  • ভিটামিন সি,
  • থায়ামিন (ভিটামিন বি১),
  • রিবোফ্লাবিন (ভিটামিন বি২),
  • নায়াসিন (ভিটামিন বি৩),
  • প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড (ভিটামিন বি৫),
  • ভিটামিন বি৬,
  • ফোলেট (ভিটামিন বি৯)
  • ক্যালসিয়াম,
  • ম্যাগনেসিয়াম,
  • ম্যাঙ্গানিজ,
  • ফসফরাস,
  • পটাশিয়াম,
  • সোডিয়াম,
  • জিংক,
  • লৌহ,
  • সেলেনিয়াম,
  • এলিসিন,
  • সালফার, প্রভৃতি পুষ্টি উপাদানে ভরপুর রসুন। তাই রসুনের উপকারিতা অপরিসীম।

রসুনের উপকারিতা

রসুনের পুষ্টিগুণ অধিক হওয়ায় এর উপকারিতা অনেক। অতি প্রাচীনকাল থেকে রসুন ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় দিক রয়েছে। নিম্নে রসুনের কিছু উপকারিতা তুলে ধরা হলো:

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে

রসুনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ এন্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি শরীরের মেটাবলিজম সিস্টেমকে উন্নত করে। এছাড়াও ব্রণের সমস্যা দূর করতে এবং ত্বককে বুড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।


রসুনে প্রায় ১৭ ধরনের অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে। এই অ্যামিনো এসিড শরীরের ভেতরের অঙ্গ-পতঙ্গগুলোকে সক্রিয় করতে সাহায্য করে। কারণ মানুষের শরীরে প্রায় ৭৫ শতাংশে থাকে এই অ্যামিনো অ্যাসিড। তাই প্রতিদিন খালি পেটে দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পায়।

কৃমি নাশক

রসুনে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান রয়েছে যা শরীরের বিভিন্ন সংক্রামন জনিত রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। রসুনে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান দেহে খারাপ ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ, জন্ম এবং বংশবিস্তারে বাধা প্রদান করে। প্রতিদিন দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে দেহের অভ্যন্তরীণ ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া এবং কৃমি ধ্বংস করতে সাহায্য করে।

শ্বাসকষ্ট কমায়

রসুন ফ্লু এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। দীর্ঘমেয়াদি হুপিং কাশি ও ব্রঙ্কাইটিসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে।এটা যক্ষ্মা রোগের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করে। এছাড়াও দাদ,খোস-পাঁচড়া ধরনের চর্মরোগ হতে রক্ষা করে।

হজমে সহায়তা করে

রসুন পরিপাকতন্ত্রের নানা সমস্যা দূর করে। নিয়মিত রসুন খেলে হজম শক্তি বাড়ে, ক্ষুধামন্দা ভাব দূর হয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা সহজে ভালো হয়ে যায়।

কোলেস্টেরল কমায়

দেহে উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল ক্ষতি করে এমনটা অনেকেই জানে। এই কোলেস্টেরলের আবার ভালো ও মন্দ দিক রয়েছে। মন্দ কোলেস্টেরল দেহের ক্ষতি করে। রসুন দেহের খারাপ কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। যার ফলে দেখা যায় হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমে।

উচ্চ রক্তচাপ দূর করে

রসুন রক্তের খারাপ কলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল অর্থাৎ এলডিএল বেড়ে গেলে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে উচ্চ রক্তচাপ জনিত সমস্যা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

রসুনে আছে প্রচুর পরিমাণ সেলেনিয়াম ও এলিসিন যা ক্যান্সার প্রতিরোধে দারুণ কার্যকর। রসুন কোলন ক্যান্সার, গলব্লাডার ক্যান্সার, স্তন ক্যান্সার, রেক্টাল ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিদিন দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে

রসুন খেলে শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং রক্তের চিনির পরিমাণ স্বাভাবিক রাখে বলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে। এছাড়াও রসুন হরমোনাল অসামঞ্জস্যতা প্রতিরোধ করে। শরীরের ইস্ট্রোজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। রসুনের প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে বলে ইউরিন ইনফেকশন কমাতে সাহায্য করে।

অনিদ্রা দূর করে

প্রতি ১০০ গ্রাম কাঁচা রসুনের প্রায় ১.২৩৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন বি৬ রয়েছে। ভিটামিন বি৬ মানসিক চাপ কমায়, অনিদ্রা এবং মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে।

পুরুষের যৌনশক্তি বৃদ্ধি করে

নানা কারণে পুরুষের যৌনশক্তি কমে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে ধীরে ধীরে যৌনশক্তি বৃদ্ধি পাবে। রসুন রক্ত পরিশোধন করে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়। পুরুষের যৌনশক্তির মূল উৎস হচ্ছে সক্রিয় রক্ত চলাচল। এছাড়াও এটি টেস্টোস্টেরনের মাত্রা বাড়ায় এবং শুক্রাণুর কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। অর্থাৎ যৌনশক্তি বাড়াতে রসুন খুবই উপকারী।

রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে

রসুন রক্ত পরিশোধন করে রক্ত সঞ্চালন বাড়ায়।প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ২ কোয়া কাঁচা রসুন খেলে রক্ত সঞ্চালন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হয়ে যেসব রোগ সৃষ্টি করে সেটা আর হতে পারে না।

হাড় ক্ষয় রোধ করে

রসুন খেলে হাড়ের ক্ষয়রোধ ও হাড়জনিত অনেক সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। এছাড়াও হাত ও পায়ের জয়েন্টের ব্যথা দূর হয় এবং বাতের ব্যথা সারায়। প্রতিদিন দুই থেকে তিন কোয়া রসুন খেলে নারীদের শরীরের ইস্ট্রোজেনের মাত্রায় ভারসাম্য থাকে, ফলে হাড় সংক্রান্ত অনেক সমস্যা কমে যায়।

হৃদ রোগের ঝুঁকি কমায়

প্রতিদিন অন্তত দুই কোয়া কাঁচা রসুন খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। কারণ রসুন খেলে হার্টের রক্ত জমাট বাঁধে না। তাই হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে এবং সারা শরীরে রক্ত চলাচল সচল থাকে। এলডিএল কোলেস্টেরলকে মন্দ কোলেস্টেরল বলা হয়। প্রতিদিন অন্তত এক কোয়া রসুন খেলে এই খারাপ কোলেস্টেরল কমে যায়।

রসুনের অপকারিতা

সবার শরীরের জন্যই যে রসুন ভালো তা কিন্তু নয়। রসুনের কিছু কিছু গুণের জন্য আপনার শারীরিক সমস্যা বেড়ে যেতে পারে। রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা উভয় দিক রয়েছে।ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হেলথ শটস ও হিন্দুস্তান টাইমসের একটি প্রতিবেদন বলছে, রসুনের উপকারিতা সবাই নাও পেতে পারেন।
  • রসুনে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ সালফার, তাই খালি পেটে বেশি রসুন খেলে গ্যাস সৃষ্টি হতে পারে এবং ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।
  • অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্তচাপ কমে যেতে পারে। যার ফলে মাথা ঘোরানোর মত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে,দীর্ঘদিন যাবত রসুন খেলে শরীরে ঘাম বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
  • গর্ভাবস্থায় নারীদের রসুন না খাওয়াই ভালো। কারণ গর্ভবতী নারীদের রসুন খেলে প্রসব বেদনা বেড়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। এছাড়াও শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময়কালে মায়েদের রসুন না খাওয়াই ভালো। কারণ রসুন খেলে দুধের স্বাদ পাল্টে যাওয়া সম্ভাবনা থাকে।
  • অতিরিক্ত রসুন খেলে রক্ত পাতলা হয়ে যায়। তাই দীর্ঘদিন যাবত রসুন না খাওয়াই ভালো।
  • দিনে দুই কোয়ার বেশি কাঁচা রসুন না খাওয়াই ভালো। রান্নায় রসুন ব্যবহৃত হলেও দিনে দুই কোয়া রসুন খাওয়া যায়।
  • এলার্জি কিংবা অন্য কোন কারণে রসুন খাওয়া বন্ধ থাকলে সে ক্ষেত্রে রসুন না খাওয়াই ভালো। আবার দেখা যায় রসুন খেলে অনেকের এলার্জি জনিত সমস্যা বেড়ে যায়।
  • অতিরিক্ত রসুন খেলে নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ ও বমি ভাব হতে পারে। কারণ রসুনে থাকা সালফার মুখে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে।
  • অতিরিক্ত রসুন খেলে 'হাইফিমা'রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ 'আইরিস'ও কর্ণিয়ার মাঝে রক্ত ক্ষরণ ঘটতে পারে। যার ফলে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যেতে পারে।
  • অতিরিক্ত রসুন খাওয়া উচিত নয়। কারণ রসুনে থাকে 'অ্যালিসিন'উপাদান,যা যকৃতে বিষক্রিয়া তৈরি করতে পারে।
  • যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, খালি পেটে কাঁচা রসুন সেবন করলে বুক জ্বালাপোড়া, বমিভাব ও বমি হতে পারে। এছাড়াও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়,রসুনে এমন কিছু উপাদান আছে যা জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রোয়েসোফাজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ হওয়ার অন্যতম কারণ।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, রসুনের উপকারিতা অপরিসীম। কাঁচা রসুনের উপকারিতা বেশি। সকালে খালি পেটে যারা কাঁচা রসুন খেতে পারেন না তারা দিনে যে কোন সময়ে দুই কোয়া রসুন খেতে পারেন। আর যাদের কাঁচা রসুন খেলে সমস্যা হয় তারা রান্না করে অথবা আচার বানিয়ে খেতে পারে। তবে দিনে দুই কোয়ার বেশি কাঁচা রসুন খাওয়া উচিত নয়।যাদের রসুন খেলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় তারা অবশ্যই রসুন এড়িয়ে চলুন। আজকের আর্টিকেলে রসুনের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url