আয়ন বায়ু কাকে বলে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন আয়ন বায়ু কাকে বলে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। মূলত আয়ন বায়ুর অপর নাম বাণিজ্য বায়ু। উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে (৩০°-৩৫°উ.ও দ. অক্ষাংশ) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে প্রবাহমান বায়ু আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু নামে পরিচিত।আয়ন বায়ু কাকে বলে আজকের আর্টিকেলে সেটা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে যে বায়ু প্রবাহিত হয় থাকে তাকে আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু বলে।আজকের আর্টিকেলে আয়ন বায়ু কাকে বলে সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করব।
আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু
উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে (৩০°-৩৫°উ.ও দ. অক্ষাংশ) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে প্রবাহমান বায়ু আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু নামে পরিচিত। জার্মান শব্দ trade এর অর্থ track বা পথ। blow trade শব্দের অর্থ অবিরত ভাবে একই দিকে স্থায়ীভাবে প্রবাহিত হওয়া। ইংরেজি শব্দ trade এর অর্থ বাণিজ্য যা অনেকে এটার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। তারা পুরাকালে বাণিজ্যিক পালতোলা জাহাজ এর গতিপথ অনুসরণ করত বিধায় এর নামকরণ বাণিজ্য বায়ু করেছে।
কর্কটীয় উত্তর-পূর্ব এবং মকরীয় দক্ষিণ-পূর্ব উচ্চচাপ বলয় থেকে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে এ বায়ু সর্বদা প্রবাহিত হতে দেখা যায়। উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু ঘন্টায় ১৬ কিলোমিটার এবং দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু অধিকাংশ সময় বাধাহীনভাবে সমুদ্রপথে চলে বলে প্রায় ২২.৪ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এই বায়ু নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে ৫°-৩৫°অক্ষাংশের মধ্যে প্রবাহিত হয়।সমগ্র উষ্ণমন্ডলের অর্ধেকের বেশি এলাকায় এই বায়ু প্রবাহিত হয় তবে শীতকালেই বেশি শক্তিশালী হয়। পূর্বকালে পালতোলা জাহাজ চলাচলে এই অবাধ গতিসম্পন্ন বায়ু প্রবাহ বিশেষ উপযোগী ছিল বলেই বাণিজ্য বায়ু নামে নামকরণ হয়।
আরো পড়ুন:নিয়ত বায়ু প্রবাহ আলোচনা কর
আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ু উচ্চ অক্ষাংশ (শীতল স্থান) হতে নিম্ন অক্ষাংশে (উষ্ণতর স্থান) প্রবাহিত হয় বলে এদের জলীয়বাষ্প ধারণ করার শক্তি বৃদ্ধি পায়।তাই এ বায়ুতে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না। ফলে এ বায়ুর প্রবাহের গতিপথে মহাদেশগুলোর পশ্চিমে পৃথিবীর অধিকাংশ (কালাহারি, সাহারা, আতাকামা প্রভৃতি) মরুভূমিগুলো অবস্থিত।তবে এ বায়ুর যে অংশ সমুদ্রের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উচ্চ পর্বতগাত্রে বাধা পায় সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়।তাই আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ুর প্রভাব যুক্ত অঞ্চলে মহাদেশসমূহের পূর্ব দিকে কখনো কখনো বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে।
আয়ন বায়ু বা বাণিজ্য বায়ুর বৈশিষ্ট্য
আয়ন বায়ুর বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য রয়েছে।আয়ন বায়ুর যেসব বৈশিষ্ট্যগুলো পরিলক্ষিত হয় নিম্নে সেটা বর্ণিত হল:
১) আয়ন বায়ু উত্তর গোলার্ধে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। কোরিওলিস শক্তির কারণে এই বায়ুদ্বয় (উত্তর ও দক্ষিণ আয়ন বায়ু) উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায় ফেরেলের সূত্রানুসারে।
উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নামে পরিচিত।
২) আয়ন বায়ু ৩০° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ হতে নিরক্ষীয় নিম্ন চাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
৩)মহাদেশীয় ভূ-ভাগ অতিক্রম করায় আয়ন বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না। মহাদেশের পূর্বাংশে কিছুটা সমুদ্রভাগ অতিক্রম করে আসায় আয়ন বায়ু জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটালেও পশ্চিমাংশে কোন বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। এজন্য আয়ন বায়ু প্রবাহিত মহাদেশের পশ্চিমাংশ বৃষ্টিহীন এবং ক্রান্তীয় মরুভূমিসমূহ এই বায়ু প্রবাহের গতিপথে সৃষ্টি হয়েছে।
৪)নিরক্ষীয় অঞ্চলে গমন করলে আয়ন বায়ু জলভাগ থেকে আদ্রর্তা গ্রহণ করে সিক্ত হয় এবং অস্থিতিশীল হয়ে উর্ধ্বগামী হয়। এক্ষেত্রে আয়ন বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ পূর্ব আয়ন বায়ু পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং যে রেখা বরাবর এ সংঘর্ষ ঘটে যা আন্ত:ক্রান্তীয় অভিসরন হিসাবে আখ্যায়িত।
৫) আয়ন বায়ু ঘন্টায় ১৫-২৫ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয় এবং সারাবছর এর গতিপথ নির্দিষ্ট থাকে।
৬) আয়ন বায়ু যখন সমুদ্রভাগ অতিক্রম করে তখন এর গতিবেগ অনেক বেড়ে যায়। কারণ মহাসাগরের ওপর এগুলো বেশি মাত্রায় বিকাশ লাভ করে।
৭)ভারত মহাসাগর আয়ন বায়ু পরিবর্তিত হয়ে গ্রীষ্মকালে মৌসুমী বায়ুতে পরিণত হয়। অন্যভাবে বলা যায় গ্রীষ্মকালে ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বায়ু আয়ন বায়ুর স্থান দখল করে।
৮) তুলনামূলকভাবে শীতল এলাকা থেকে আসা আয়ন বায়ুপ্রবাহের ফলে মনোরম আবহাওয়া সৃষ্টি হয়।
৯) মহাদেশের ওপরে শীতকালে আয়ন বায়ু নিয়মিত ও একইরূপ থাকে।এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সমগ্র পৃথিবীর এই সংক্রান্ত মডেল তৈরি করেন বৈজ্ঞানিক হ্যাডলি আর বাণিজ্য বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলের নামকরণ হয় Hadley Cell.
১০) এই বায়ু প্রবাহগুলো শীতকালে অত্যন্ত প্রবল হয় এবং গ্রীষ্মকালে অত্যন্ত দুর্বল হয়। উত্তর ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ চলাকালীন সময়ে আটলান্টিকের চেয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে দুর্বল অবস্থাপ্রাপ্ত হয়।
১১) আয়ন বায়ু ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে ক্রমান্বয়ে উষ্ণ অবস্থায় যখন নিরক্ষীয় অঞ্চলের দিকে যেতে থাকে তখন বৃষ্টিপাত বহন করে না। ক্ষেত্রবিশেষে পাহাড়ের গায়ে বাধা পেয়ে কিছু বৃষ্টিপাত ঘটায়।
শেষ কথা
কর্কটীয় ও মকরীয় উপচাপ বলয় দুইটি (২৫°থেকে ৩৫°, উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ ) হতে সারা বছর নিয়মিতভাবে নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলায়ের (০°থেকে ১০°উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ) দিকে বায়ুর প্রবাহিত হচ্ছে। এ বায়ুকে মূলত আয়ন বা বাণিজ্য বায়ু বলা হয়। উত্তর গোলার্ধে এ বায়ু নিরক্ষীয় প্রদেশের দিকে আসার সময় পৃথিবীর আবর্তনের জন্য ফেরেলের সূত্র অনুসারে বেঁকে উত্তর-পূর্ব বায়ুতে পরিণত হয়। দক্ষিণ গোলার্ধে এরুপ বায়ু প্রবাহ নিরক্ষীয় প্রদেশের দিকে আসতে থাকে এবং ফেরেলের সূত্র অনুসারে বাঁদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পূর্ব প্রবাহে পরিণত হয়। আজকের আর্টিকেলে আয়ন বায়ু কাকে বলে সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।