স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।কারন আজকের আর্টিকেলে স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেষ্টা করব।তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় ও বিবিধ ভৌগোলিক কারণে এক ধরনের বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়, একে স্থানীয় বায়ু বলে। স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে নিম্নে বর্ণিত হল:

স্থানীয় বায়ু (Local Winds)

বায়ু সর্বদা এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। যেহেতু বায়ুমণ্ডল ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে সর্বদা প্রবাহিত হচ্ছে তাই একে স্থির ভাবে কোন একটা স্থানে ধরে রাখা যায় না।ভূপৃষ্ঠের সমান্তরাল অর্থাৎ অনুভূমিক ভাবে বায়ুর এ প্রবাহিত হওয়াকে বায়ুপ্রবাহ বলে।ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়া গত বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে স্থানীয় বায়ুর সৃষ্টি হয়। এই বায়ু প্রবাহের স্থায়িত্ব কম এবং সীমিত এলাকা জুড়ে সৃষ্টি হয়। স্থানীয় বায়ু দুই প্রকারের হয়ে থাকে।

ক) উষ্ণ প্রকৃতির স্থানীয় বায়ু,

খ) শীতল প্রকৃতির স্থানীয় বায়ু,

ক) উষ্ণ প্রকৃতির স্থানীয় বায়ু

নিম্নে কয়েকটি প্রসিদ্ধ উষ্ণ প্রকৃতির স্থানীয় বায়ুর বর্ণনা দেওয়া হলো:

১/চিনুক (Chinook)

উত্তর আমেরিকার রকি পর্বতের পূর্ব পার্শ্বের উষ্ণ ও শুষ্ক প্রবাহিত বায়ুকে চিনুক বলে। চিনুক শব্দের অর্থ হচ্ছে তুষার খাদক। শীত ও বসন্তকালে এ বায়ু নিচে নামলে হঠাৎ তাপমাত্রা ২০°থেকে ৩০° সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে এ অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করে। এ কারণে স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ানগন এ বায়ুকে তুষার খাদক বলে থাকে।


এ বায়ুর ফলে স্থানীয় তৃণভূমি অঞ্চলে শীতকালে পশুচারণের পক্ষে সুবিধাজনক হয়। আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল থেকে আর্জেন্টিনার পাম্পাস (Pampas) তৃণভূমির উপর দিয়ে শীতল বায়ুকে পাম্পেরা বলে। পার্বত্য উপত্যকার মধ্য দিয়ে নিম্মদিকে প্রবাহিত উষ্ণ বায়ুকে ক্যালিফোর্নিয়ার সান্টানা বলে।এ ছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার বার্গ (Berg), পারস্যের সামুন (Sumun) প্রভৃতি এ জাতীয় বায়ু।

২/ফন(Fohn)

ইউরোপের আল্পস পর্বতের উত্তর ঢাল বেয়ে যে উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু পর্বত মধ্যস্থিত উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় তা ফন বা ফ্যার্ন বলে পরিচিত। নিম্নচাপ জনিত কারণে সৃষ্ট বায়ুপ্রবাহটি প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু উত্তর ঢালে পৌঁছলে উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ুরূপে রাইন উপত্যকার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়ে তুষার গলে যায় এবং হিমানী সম্প্রপাত ঘটে। বসন্তকালে এ বায়ু বেশি প্রবাহিত হয় বলে উত্তর সুইজারল্যান্ডের তৃণভূমি বরফমুক্ত হয় এবং তথায় পশুচারণের পক্ষে খুবই উপযুক্ত হয়।

৩/হারমাটন (Harmattan)

এটি একটি স্থানীয় বায়ু। কারণ স্থানীয়ভাবে তাপ ও বায়ুর চাপের পার্থক্যর জন্যই এই প্রকার বায়ুর উৎপত্তি হয়। সাহারা মরুভূমি হতে বালুকা বহন করে যে শুষ্ক বায়ু পশ্চিম আফ্রিকার দিকে প্রবাহিত হয় তাকে হারমাটন বলে।এ বায়ু প্রবাহের ফলে অনেক সময় গিনি উপকূলে গাঢ় কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি হয় এবং নৌ- চলাচলের বিঘ্ন ঘটে।প্রায় সারা বছর কম বেশি এ বায়ু দেখা যায়।সর্বোপরি এটি একটি অস্বাস্থ্যকর বায়ু।

৪/খামসিন (Khamsin)

উত্তর আফ্রিকা ও সৌদি আরব এলাকায় খামসিন বায়ু প্রবাহ লক্ষ করা যায়। শীতের শেষ ভাগে ও বসন্তের শুরুতে এ বায়ুর আগমন ঘটে। এটিও মূলত উষ্ণ ও শুষ্ক বায়ু (উষ্ণতা ৪০°-৫০°সে. এর মধ্যে থাকে)। মিশরের দক্ষিণ দিক হতে এ উষ্ণ বায়ু মিশরে প্রবেশ করে। এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৫০ দিন এই বায়ু মিশরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে একে খামসিন বলা হয়। কারণ আরবি ভাষায় খামসিন অর্থ পঞ্চাশ। ভূমধ্যসাগরীয় নিম্নচাপের ফলে এ বায়ুর উৎপত্তি হয়।

৫/লেভেন্টার (Levanter)

পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় প্রবাহিত বায় লেভেন্টার নামে পরিচিত। শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তকালে এই প্রকার বায়ু প্রবাহিত হয়। ইহা উষ্ণ ও আর্দ্র প্রকৃতির বায়ু।

৬/লু (Loo)

গ্রীষ্মকালে দিনের বেলায় উত্তর-পশ্চিম ভারতের স্থলভাগ খুব উত্তপ্ত হয়।বিভিন্ন বায়ুস্তরের দ্রুত তাপের বিনিময়ে ঘটে। উষ্ণ বায়ু ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়।দিবাভাগের উষ্ণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বায়ুর গতিবেগও বেড়ে যায়।এ বায়ুকে লু' বলা হয়। মূলত লু' হাওয়া প্রবাহিত হয় উত্তর-পশ্চিম ভারতের থর মরুভূমিতে। এ বায়ু শুষ্ক, উষ্ণ ও পীড়াদায়ক।

৭/পাম্পেরো (Pampero)

আর্জেন্টিনা ও উরুগুয়ের পাম্পাস এলাকায় যে শীতল ও মেরুদেশীয় বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে পাম্পেরো বলে। এটি দমকা বাতাসের ন্যায় এবং দক্ষিণ হতে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়। এর ফলে ঝড়-বৃষ্টি হয়।পাম্পাস এলাকায় গ্রীষ্মকালে প্রায়ই এ বায়ু প্রবাহিত হয়।

৮/সিরক্কো (Sirocco)

ভূমধ্যসাগরে ওপর দিয়ে যে নিম্নচাপ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয় তাকে পুরো ভাগে যে বায়ু থাকে তাকে সিরক্কো বলে। তাই সকল ঋতুতে এ বায়ু প্রবাহিত হতে পারে। উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি ও ইতালিতে এরূপ বায়ু দেখা যায়। এ বায়ু দক্ষিণ-পূর্ব স্পেনে লিভেস,তিউনিসে চিলি (Chili), মিশরে খামসীন এবং লিবিয়ায় গিবলী (Gibli) নামে পরিচিত।

৯/সোলানো(Solano)

দক্ষিণ-পূর্ব স্পেন এবং জিব্রাল্টার প্রণালী অঞ্চলে যে বায়ু পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়,তাকে সোলানো বায়ু বলে।এ বায়ুর প্রভাবে জিব্রাল্টার অঞ্চলে ঘূর্ণিবাতের সৃষ্টি হয় এবং বৃষ্টিপাতও হতে দেখা যায়।

১০/সাইমুম (Simoom)

সাহারা ও আরবের মরুভূমিতে গ্রীষ্ম ও বসন্তকালে যে বাতাস অনুভূত হয় তাকে সাইমুম বলে।এ ঝড় শেষ হলে দেখা যায় যে, বালুকা সঞ্চিত হয়ে বহু বালিয়াড়ির সৃষ্টি হয়েছে।

খ) শীতল প্রকৃতির স্থানীয় বায়ু

১/বোরা (Bora)

শীতকালে উত্তর ইতালি ও আড্রিয়টিক সাগরের পূর্ব উপকূল দিয়ে যে শীতল ও শুষ্ক উত্তর-পূর্ব বায়ু প্রবাহিত হয় তাকে বোরা(Bora)বলে।ভূমধ্যসাগরীয় নিম্নচাপ ও ইউরোপীয় উচ্চচাপের ফলে এ বায়ু প্রবাহের উৎপত্তি হয়।এ বায়ু প্রবাহের ফলে অনেক সময় বৃষ্টি ও ঘূর্ণিবাত্যা সংঘটিত হয়।কখনো কখনো এ বাতাস ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয়।

২/ক্যাটিয়াবেটিক বা নিকাশী বায়ুপ্রবাহ (Katiabatic Wind)

পর্বতের তুষার ক্ষেত্র থেকে শীতল ও ভারী বাতাস ক্রমশ নিচের দিকে নামতে থাকলে তাকে ক্যাটিয়াবেটিক বা নিকাশী বায়ু বলে।বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন নামকরণ আছে যেমন:ফ্রান্সে মিস্ট্রাল (Mistral),আলাস্কায় টাকু (Taku) প্রভৃতি।

শেষ কথা

পৃথিবীর কোন স্থানে উচ্চচাপ বলয় আবার কোন কোন স্থানে নিম্নচাপ বলয় অবস্থান করে। সাধারণ ধর্ম অনুসারে ভূপৃষ্ঠের বায়ু সর্বদা উচ্চচাপ বলয় হতে নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়। বায়ুর এ স্বাভাবিক ধর্ম সর্বত্র প্রচলিত থাকলেও সকল স্থানে প্রায়ই বায়ুর চাপের পরিবর্তন হয়। বায়ু চাপের পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ুপ্রবাহেরও পরিবর্তন হয়। এ সকল কারণে ভূপৃষ্ঠের ওপর প্রবাহিত বায়ুর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। আর এ সকল কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রকার বায়ু প্রবাহিত হতে লক্ষ্য করা যায়। আজকের আর্টিকেলে স্থানীয় বায়ু কাকে বলে-স্থানীয় বায়ুর শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url