বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব কতটুকু। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব আলোচনা কর
কৃষির উন্নয়ন হলে দেশের অর্থনীতিতে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবে। কারণ এদেশের প্রায় ৭৫ % মানুষ পতাক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে চাইলে অবশ্যই কৃষির উন্নয়ন বাড়াতে হবে।

ভূমিকা

মানুষের আদিম পেশাগুলোর মধ্যে কৃষিকাজ অন্যতম। বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫% প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। এদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের এক- তৃতীয়াংশ কৃষি থেকে আসে। বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। এদেশের অর্থনীতি প্রধানত কৃষি নির্ভর। তাই এদেশের কৃষি মূলত অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব/প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের অর্থনীতির কথা ভাবলেই প্রথমে আসে কৃষির কথা। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো:

১/জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উৎস হলো কৃষি। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে দেশের জাতীয় আয়ের কৃষির অবদান ছিল ১৬. ৯৮ শতাংশ। বাংলাদেশে কৃষির উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কৃষির অবদান আরো বাড়বে। কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে এ দেশের জাতীয় উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিও ত্বরান্বিত হবে। শিল্পের উন্নয়ন ও ক্রমবিকাশের সাথে সাথে কৃষির গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেলেও দীর্ঘদিন যাবত কৃষি এদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ যোগান দিচ্ছে।

২/খাদ্যশস্যের যোগানদাতা

মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান উপকরণ হলো খাদ্য। বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের যোগানদাতা হিসেবে কৃষির অবদান ব্যাপক। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হলো চাল,গম,ডাল,শাকসবজি,তেল বীজ, ফলমূল প্রভৃতি। কৃষি থেকে এসব খাদ্যশস্য পাওয়া যায়। কৃষির আধুনিকীকরণ সম্ভব হলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে। বাংলাদেশে খাদ্য যোগানের ক্ষেত্রে কৃষি যে ভূমিকা পালন করছে তা আরও বাড়বে, যদি কৃষি উন্নয়ন করা সম্ভব হয়।

৩/প্রধান পেশা

কৃষি বাংলাদেশের মানুষের প্রধান পেশা। মোট জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল এবং কৃষিতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৫১.৬৯%। উন্নত দেশসমূহে কৃষির উপর নির্ভরশীলতার হার ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে। বাংলাদেশের জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল বলে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হলে অবশ্যই কৃষির উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪/কর্মসংস্থান

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি কর্মসংস্থানের এক উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। আমাদের শ্রমশক্তির সিংহভাগ কৃষিতে নিয়োজিত রয়েছে। কৃষিতে মোট শ্রম শক্তির শতকরা ৫১.৬৯ ভাগ লোক নিয়োজিত। বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে বেকারত্ব ও আংশিক বেকারত্ব শতকরা ৩৩ ভাগ। কৃষিতে এ ধরনের বেকারত্ব এদেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ ঘটিয়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমবিভাগ নিশ্চিত করতে পারলে কৃষিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ অবশ্যই বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

৫/রাজস্বের উৎস

কৃষি সরকারি রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জমির খাজনা, কৃষি পণ্য, পরিবহনের ভাড়া, কৃষি পণ্যের রপ্তানি শুল্ক ইত্যাদি বাবদ সরকার প্রচুর রাজস্ব পেয়ে থাকে। কৃষির উন্নয়ন হলে সরকার কৃষি থেকে আরও রাজস্ব লাভ করতে পারবে। ভূমি রাজস্ব থেকে সরকার ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরের বাজেটে ৪৬৩ কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

৬/শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বাংলাদেশের অধিকাংশ শিল্পই কৃষিনির্ভর। আমাদের অধিকাংশ শিল্পই কৃষি থেকে সরবরাহকৃত কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের পাঠ, চা, চিনি, সিগারেট, দিয়াশলাই, কাগজ প্রভৃতি শিল্পের কাঁচামাল প্রধানত কৃষি থেকেই পাওয়া যায়। কৃষি কাঁচামাল সরবরাহ করে বাংলাদেশে শিল্পায়নের গতি বৃদ্ধি করেছে। কৃষি এদেশের শিল্পের বিকাশে কাঁচামাল সরবরাহ করে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।

৭/বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন

বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কৃষির অবদান অপরিসীম। এদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের বেশিরভাগ পণ্যই হলো কৃষিজাত। এদেশের বৈদেশিক মুদ্রা শতকরা প্রায় ৭. ৩৪ ভাগই কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করে পাওয়া যায়। পাট,চা,চামড়া,পোশাক,তামাক প্রভৃতি কৃষিজাত দ্রব্যই এদেশের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। সুতরাং কৃষি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সহায়তা করছে।

৮/কৃষি সহায়ক শিল্পের প্রসার

কৃষির উন্নয়ন কৃষি সহায়ক শিল্পের প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে থাকে। কৃষি উন্নয়নের জন্য রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ট্রাকক্টর,গভীর ও অগভীর নলকূপ, হারভেস্টার, মাড়াই যন্ত্র এবং অন্যান্য আধুনিক কৃষি উপকরণের প্রয়োজন হয়। কৃষির উন্নয়ন, কৃষি সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা এবং তার সম্প্রসারণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

৯/ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার

কৃষির উৎপাদন বাড়লে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে। কৃষিজাত দ্রব্য অধিক পরিমাণে উৎপাদিত হলে অভ্যন্তরীণ ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। এতে দেশের পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হয়। কারণ কৃষিজাত বিভিন্ন দ্রব্য বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। সুতরাং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

১০/জ্বালানি সরবরাহ

বাংলাদেশ মূলত গ্রাম প্রধান দেশ। এদেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বসবাস করে। গ্রামীণ মানুষ কৃষি থেকে প্রাপ্ত শত,খড়,পাটখড়ি,বাঁশ,কাঠ,গোলপাতা ইত্যাদি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ফলে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যায় অনেকটা সাশ্রয় হয়।

১১/বাসস্থানের উপকরণ যোগান

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। আর এ দারিদ্রতা জন্যই তাদের পক্ষে পাকা ঘর বা টিনের ঘর তৈরি করা সম্ভব হয় না।তাই তারা বাঁশ,বেত,কাঠ,গাছপালা, শণ, খড়, গোলপাতা, ইত্যাদি দ্বারা বাসস্থান নির্মাণ করে থাকে। বাসস্থান নির্মাণের এসব সামগ্রী কৃষিই যোগান দেয়।

১২/বস্ত্রের যোগান

বস্ত্রের যোগানের ক্ষেত্রেও কৃষির ভূমিকা ব্যাপক।পাট, তুলা,রেশম এবং অন্যান্য আশ কৃষি থেকে পাওয়া যায় যা দিয়ে কাপড় উৎপন্ন হয়। বস্ত্র উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ করে কৃষি আমাদের বস্ত্রের অভাব পূরণ করছে। এদেশের উৎপাদিত বস্ত্র বর্তমানে চাহিদার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ মিটাতে সক্ষম হচ্ছে। কৃষি যথাযথভাবে উন্নত হলে আমাদের বস্ত্র চাহিদার সবটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দ্বারা মিটানো সম্ভব হবে।

১৩/শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সৃষ্টি ও শিল্পোন্নয়নে সহায়তা

শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সৃষ্টি এবং শিল্পোন্নয়নে কৃষি সহায়তা করে থাকে। কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমেই কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পায় এবং তারা শিল্পজাত দ্রব্য ক্রয় করে। কৃষকদের ক্রয় ক্ষমতা কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে বাড়লে তারা শিল্পজাত দ্রব্যের বাজার সৃষ্টি করে থাকে।এর ফলে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠে এবং শিল্পোন্নয়নের গতি বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে শিল্পোন্নয়নের জন্য কৃষির উন্নয়ন একান্ত আবশ্যক।

১৪/জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা কৃষির সাথে সরাসরি জড়িত। কৃষিখাত থেকেই মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পেয়ে থাকে। কৃষির উন্নতির উপরই মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি নির্ভরশীল। তাই মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে কৃষি।তাই কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান বহুমুখী এবং কৃষি ব্যতীত এদেশের অর্থনীতির কথা কল্পনা করা যায় না। কৃষির উন্নয়নে এদেশের সকলের মনোযোগী হওয়া উচিত। তাছাড়া এটি সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। জমির খাজনা, কৃষিপণ্যের উপর ধার্যকৃত কর, কৃষিপণ্য পরিবহন বাবদ ভাড়া প্রভৃতি থেকে সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব আয় করে থাকে। তাই সরকারের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে কৃষির অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url