বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর
বাংলাদেশের জলবায়ু শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষা এ তিনটি ঋতুর সাথে অতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। তাই ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তিত হয়। এদেশের জলবায়ু অনেকটা সমভাবাপন্ন হলেও মৌসুমী বায়ু দ্বারা সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহর মধ্যে প্রধান দিকগুলো হচ্ছে গ্রীষ্মকাল আর্দ্র,শীতকাল শুষ্ক এবং বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

ভূমিকা

বাংলাদেশের জলবায়ু মোটামুটি উষ্ণ,আর্দ্র ও সমভাবাপন্ন।বাংলাদেশের মাঝ দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা অতিক্রম করায় এখানে ক্রান্তীয় জলবায়ু বিরাজ করে। কিন্তু মৌসুমী বায়ুর প্রভাব এ দেশের জলবায়ুর উপর এত বেশি যে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। বাংলাদেশের জলবায়ুর নানাবিধ বৈশিষ্ট্য রয়েছে এবং এ বৈশিষ্ট্য নানাভাবে এ দেশ ও দেশের মানুষের উপর প্রভাব ফেলেছ।

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ

নিম্নে বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো:

১/ মৌসুমী জলবায়ু

ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ুপ্রবাহের গতি পরিবর্তিত হয়ে যে জলবায়ুর সৃষ্টি হয় তাই মৌসুমী জলবায়ু নামে পরিচিত। বাংলাদেশকে মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল বলা হয়। কারণ গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু প্রবাহিত হয়। সুতরাং মৌসুমী জলবায়ু বাংলাদেশের জলবায়ুর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

২/উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুপ্রবাহ

বাংলাদেশের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু প্রবাহ। দক্ষিণ দিক থেকে উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুপ্রবাহ ২ কিলোমিটার পর্যন্ত ঊর্ধ্বে উঠে এবং এর উপরিস্থ অপেক্ষাকৃত শীতল ও শুষ্ক বায়ু প্রবাহ উত্তর-পশ্চিম ও পশ্চিম দিক থেকে আসতে থাকে। এ দুই বায়ু প্রবাহ পরস্পরের সংস্পর্শে আসা মাত্র ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়।

৩/গ্রীষ্মকালে বৃষ্টিপাত

বাংলাদেশ গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত মৌসুমি বায়ুতে প্রচুর জলীয়বাষ্প থাকে। এ জলীয়বাষ্প সম্পন্ন মৌসুমী বায়ু প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। গ্রীষ্মকালে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত এবং পশ্চিম অঞ্চলে কম বৃষ্টিপাত হয়। সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত হয় নাটোরের লালপুরে এবং সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় সিলেটের লালখানে। এ সময়ে বৃষ্টিপাত প্রধানত কালবৈশাখী থেকেই সংঘটিত হয়। অনেক সময় ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মকালে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ২০%।

৪/বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ মধ্যে বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা অন্যতম। সাধারণত জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। কিন্তু অনেক সময় এ বায়ু অনিয়মিত ও অপরিমিত বৃষ্টিপাত ঘটায়। ফলে অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

৫/শীতকালে বৃষ্টি না হওয়া

বাংলাদেশের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শীতকালে বৃষ্টিপাত না হওয়া। শীতকালে বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত মহাদেশীয় উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুতে কোন জলীয়বাষ্প থাকে না; তাই এ সময় এ বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটায় না।এজন্য বাংলাদেশে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। দেশের মোট বৃষ্টিপাতের প্রায় ৪% শীতকালে হয়ে থাকে। উপকূলবর্তী অঞ্চল ও পূর্ব দিকের পার্বত্য অঞ্চলেই বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কোন কোন বছর বঙ্গোপসাগর থেকে আগত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েকদিন বৃষ্টিপাত হয়।

৬/তাপমাত্রার তারতম্য

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ মধ্যে তাপমাত্রার তারতম্য বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশে শীতকাল সবচেয়ে আরামপ্রদ ও উপভোগ্য ঋতু।এ সময় আবহাওয়া খুব শীতল থাকে। বাংলাদেশে শীতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ২৪°- ৩০°সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৭°-১৩°সেলসিয়াস এর মধ্যে বিরাজ করে।


জানুয়ারি মাস বাংলাদেশের সবচেয়ে শীতলতম মাস। অন্যদিকে গ্রীষ্মকালের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৪২° সেলসিয়াসে পৌঁছে এবং সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২১° সেলসিয়াস বিরাজ করে। সুতরাং তাপমাত্রা তারতম্য বাংলাদেশের জলবায়ুর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

৭/বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা

বাংলাদেশের জলবায়ুর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা।যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সবচেয়ে কম সেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা সর্বাধিক। যেমন: রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতা সর্বাধিক। অন্যদিকে যেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি সেসব অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতার হার সবচেয়ে কম। যেমন: সিলেট অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনশীলতার হার সর্বনিম্ন।

৮/বৃষ্টিপাত ও বন্যা

জলীয়বাষ্পপূর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুরপ্রবাহের ফলে বর্ষাকালে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। মোট বৃষ্টিপাতের ৭৫% বর্ষাকালেই হয়ে থাকে। এ সময় গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বনিম্ন ১১৯ সেন্টিমিটার এবং সর্বোচ্চ ৩৪৫ সেন্টিমিটার। এ সময় সিলেট ও কক্সবাজারে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় এবং পাবনা ও রাজশাহীতে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের সাথে প্রায় নিম্নচাপ ও ঘূর্ণাবর্তের সংযোগ থাকে।এ সময় বৃষ্টির পানি নদীর দুই কুল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বন্যার সৃষ্টি করে।এর ফলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়।

৯/বায়ুচাপ

বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ মধ্যে অন্যতম শীতকালে উচ্চচাপ ও গ্রীষ্মকালীন নিম্নচাপ বিরাজ করে। জানুয়ারি মাসে (পৌষ-মাঘ) বায়ুর চাপ গড়ে ১০২০ মিলিবার এবং মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর(ফাল্গুন-আশ্বিন) মাস পর্যন্ত এই চাপ কমে ১০০৫ মিলিবারে পৌঁছায়। বায়ুচাপের তারতম্যের ফলেই এ সময় বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহ ও তজ্জনিত ঝড়ো-হাওয়াসহ বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে।

১০/কুয়াশা, কুজ্ঝটিকা ও শিশির

নভেম্বর- মার্চ (কার্তিক-মাঘ) কুয়াশা ও শিশিরপাত বাংলাদেশের জলবায়ুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য। সাধারণভাবে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত কুয়াশা থাকলেও ডিসেম্বর- জানুয়ারিতে কোন কোন বছর সূর্যোদয়ের পরও দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা ঘন কুয়াশার আবরণ অব্যাহত থাকে।ঐ দুই মাস শিশিরপাতও হয় অত্যাধিক। সাধারণত হেমন্তের শুরুতে (কার্তিক) শিশিরপাত আরম্ভ হয়। পশ্চিমা শীতল বায়ুর প্রভাবে উত্তরবঙ্গে কখনো কখনো কুজ্ঝটিকা দেখা যায়।

১১/সামুদ্রিক ঝড়

সামুদ্রিক ঝড় বাংলাদেশে ও তৎসংলগ্ন ভারতের রাজ্যগুলির উপকূলীয় অঞ্চলের জলবায়ুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য।বঙ্গোপসাগরের এই ঝড়গুলি সাইক্লোন হিসেবে পরিচিত। চীনে টাইফুন'এবং মধ্য আমেরিকার 'হারিকেন'ঘূর্ণিঝড়ের সাথে সাইক্লোনের সাদৃশ্য রয়েছে। তবে বাংলাদেশের উপকূলে বর্ষা ঋতুর শেষের দিকে ঘনঘন ঝড়ো হাওয়া প্রবাহিত হওয়ার প্রবণতা ছিল যা সাধারনের কাছে আশ্বিনের ঝড় নামে আখ্যায়িত। আশ্বিন- কার্তিক- অগ্রহায়ন(অক্টোবর,নভেম্বর,ডিসেম্বর) পর্যন্ত ঐ ঝড়গুলি আঘাত হানার সময়। সাইক্লোন বছরের যে কোন সময়ে এসে থাকে। তবে বর্ষার শেষ থেকে গ্রীষ্মের প্রারম্ভ পর্যন্ত প্রবণতা বেশি থাকে।

১২/মানব আচরণে প্রভাব

বাংলাদেশের জনগণের আচরণ মৌসুমী জলবায়ু দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়। মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এখানকার মানুষ আরামপ্রিয় কিছুটা কর্মবিমুখ ও কোমল স্বভাবের হয়ে থাকে। অর্থাৎ এখানকার মানুষের মেধাবিকাশে মৌসুমী জলবায়ুর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

১৩/খাদ্যাভ্যাস

বাংলাদেশে উৎপাদিত খাদ্যশস্যের সাথে এদেশের মানুষের খাদ্যাভাসের নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। অর্থাৎ বাংলাদেশে যেসব খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয় মানুষ সাধারণত সেগুলোই খেয়ে থাকে। আর এ শস্য উৎপন্নের সাথে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব রয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যাভাসে মৌসুমী জলবায়ু প্রভাব রাখছে।

১৪/কৃষিপণ্য উৎপাদনের সহায়ক

কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের মৌসুমী জলবায়ু বিভিন্ন কৃষি পণ্য উৎপাদনে অত্যান্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে এদেশে ধান,পাট,চা,ইক্ষু ইত্যাদি কৃষি পণ্য প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়।

১৫/শিল্পের সহায়ক

বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। আর কৃষি ব্যবস্থা প্রভাবিত হচ্ছে মৌসুমী জলবায়ু দ্বারা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, পরোক্ষভাবে মৌসুমী জলবায়ু বাংলাদেশে শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করছে।

১৬/জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে প্রভাব

মৌসুমী জলবায়ুর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা দ্রুত যৌবনপ্রাপ্ত হয় বলে খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে হয়। আর অল্প বয়সের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা বেশি থাকে বলে তারা অধিক সন্তান জন্ম দেয়।

১৭/পর্ণমোচী ও চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি সৃষ্টি

মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে শীতকালে বাংলাদেশে সাধারণত বৃষ্টি হয় না। ফলে এ সময় গাছের পাতা ঝরে যায়। এ কারণে এ অঞ্চলে পর্ণমোচী বৃক্ষের বনভূমি সৃষ্টি হয়। আবার গ্রীষ্মকালে মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এ অঞ্চলের গাছপালা সবুজ পাতায় আবৃত থাকে। এ কারণে এ অঞ্চলে চিরহরিৎ বনভূমির সৃষ্টি হয়। সুতরাং বাংলাদেশের জলবায়ুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো পর্ণমোচী ও চিরহরিৎ বৃক্ষের বনভূমি সৃষ্টি করা।

শেষ কথা

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উষ্ণ,আর্দ্র ও বৃষ্টিবহুল গ্রীষ্মকাল এবং মৃদু শুষ্ক শীতকাল। জলবায়ুর এরূপ বৈশিষ্ট্যের কারণে এদেশ সুজলা-সুফলা ও শস্য- শ্যামল দেশে পরিণত হয়েছে। আর মানুষের জীবন জীবিকার সাথে মৌসুমী বায়ু অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে আছে। তাই এ দেশকে মৌসুমী বায়ুর দেশ বলা হয়। আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পূর্ণভাবে বর্ণনা করার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url