বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি এদেশের জাতীয় অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড। অথচ এদেশের কৃষি ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষির একর প্রতি ফলন অত্যন্ত কম। তাই আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করা গেলে খাদ্য ঘাটতি অনেকাংশ রোধ করা সম্ভব হবে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত হবে।
ভূমিকা
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি এদেশের জাতীয় অর্থনীতির মূল মেরুদন্ড। অথচ এদেশের কৃষি ব্যবস্থা তেমন উন্নত নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের কৃষির একর প্রতি ফলন অত্যন্ত কম।ফলে জাতীয় আয়ে কৃষি খাতের অবদান খুবই নগণ্য।২০০৫-২০০৬ অর্থ বছরে কৃষিখাতের অবদান ১৬.৯৮% এবং ২০০৬-২০০৭ অর্থবছরে জাতীয় আয়ে কৃষিখাতের অবদান ১৬.৩৮% যা অন্যান্য খাতের তুলনায় খুবই কম। কৃষি আমাদের জীবনধারণের অন্যতম উৎস হলেও এই কৃষিখাত আজ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত।
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও এদেশের কৃষি নানা সমস্যায় জর্জরিত। নিম্নে বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা/অনগ্রসরতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো:
১/প্রাচীন চাষ পদ্ধতি
বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো এখানে প্রাচীন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হয়। মান্ধাতার আমলের কাঠের লাঙল-জোয়াল ও জীর্ণশীর্ণ একজোড়া বলদের সাহায্যে আজও আমাদের জমি চাষ করা হয়। এখানে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি অত্যন্ত পুরাতন। এদেশের কৃষকরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করতে জানে না, তাদের সে জ্ঞান এবং দক্ষতা কোনটাই নেই। একজোড়া বলদ এবং একটি লাঙলই তাদের কৃষিকাজের প্রধান উপকরণ।
২/জমির খন্ড-বিখন্ডতা ও বিচ্ছিন্নতা
জমির খন্ড-বিখন্ডতা ও বিচ্ছিন্নতা বাংলাদেশের কৃষির আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। বাংলাদেশের আবাদযোগ্য অধিকাংশ জমি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত এবং বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত। উত্তরাধিকার আইনের ফলশ্রুতিতে কোন কৃষকের মৃত্যুর পর তার জমি ছেলে-মেয়ে ও আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়। এতে জমি খন্ড-বিখন্ড ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
৩/প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা। কৃষি কাজের জন্য বাংলাদেশকে বৃষ্টির উপর অধিক মাত্রায় নির্ভর করতে হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখানে সময় মত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে ফসল ভালো হয়। আবার অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টি দেখা দিলে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়।
৪/উন্নত কৃষি প্রযুক্তির অভাব
বর্তমান বিশ্বে কৃষি কাজে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশিরভাগ কৃষক উন্নত কৃষি প্রযুক্তির অভাবে এখনো চাষাবাদের ক্ষেত্রে সেই মান্ধাত্মার আমলের চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করছে। তাই ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে না। উচ্চ ফলনশীল বীজ, সুসম সার, আধুনিক সেচব্যবস্থা, পোকামাকড় ও রোগ বালাই দমনের উন্নত ব্যবস্থা প্রয়োগ করে আমরা কৃষিতে ফলন বৃদ্ধি করতে পারি। কিন্তু এসব ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে এদেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা।
৫/জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা
জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বাংলাদেশের কৃষির আরেকটি প্রধান অন্তরায়। অধিক বৃষ্টিপাতের ফলে এবং পানি নিষ্কাশনের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আবাদযোগ্য বহু জমি জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ৪৪.৪ লক্ষ হেক্টর জমি জলাবদ্ধ অবস্থায় পতিত রয়েছে। এভাবে জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।
৬/উন্নত বীজ ও সারের অভাব
উন্নত বীজ ও সারের অভাব বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম সমস্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, উন্নত বীজ ও সারের ব্যবহারে কৃষির উৎপাদন শতকরা ১৫-২০ ভাগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। বাংলাদেশের উন্নত বীজ ও রাসায়নিক সারের অভাবে কৃষির উৎপাদন খুবই কম হয়।
৭/সেচব্যবস্থার অপ্রতুলতা
সেচব্যবস্থা বাংলাদেশের কৃষিকাজের জন্য একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। কিন্তু সেচব্যবস্থার অপ্রতুলতা বাংলাদেশের কৃষির একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেও এই বৃষ্টিপাত সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর। সুতরাং সেচব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে বাংলাদেশের কৃষি দ্রুত উন্নয়নের পথে অগ্রসর হতে পারছে না।
৮/ভূমির উর্বরতা হ্রাস
বাংলাদেশের জমির উর্বরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। বছরের পর বছর আবাদযোগ্য জমিগুলো একইভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ফলে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। জমির উর্বরতা কমে যাওয়ায় ফসলের উৎপাদনও কমে যাচ্ছে। সুতরাং ভূমির উর্বরতা হ্রাস বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত।
৯/ভূমিক্ষয়
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার আরেকটি সমস্যা হলো ভূমিক্ষয়। বন্যা, প্রবল বৃষ্টিপাত, বায়ু প্রবাহ প্রভৃতি কারণে ভূস্তরের উপরের হালকা কণা অপসারিত হয়ে ভূমিক্ষয় হচ্ছে। এভাবে ভূমিক্ষয়ের ফলে বাংলাদেশের জমিগুলো ক্রমশ ফসল উৎপাদনের অযোগ্য হয়ে পড়ছে।
১০/প্রাকৃতিক দুর্যোগ
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কৃষিক্ষেত্রে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতি জরুরী। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে প্রতি বছর বাংলাদেশের কৃষি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বন্যার কারণেই বাংলাদেশে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়। ২০০১ সালের বন্যায় দেশের ১৬ টি জেলার ৭৯ টি উপজেলায় ০.৪১৮ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
একইভাবে ২০০২ সালের বন্যায় ৪৫ টি জেলার ২০৮ টি উপজেলার ৩.৮৫ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল বিনিষ্ট হয়। ২০০৩ সালের সংঘটিত বন্যায় দেশে ৪৭ টি জেলায় ২৬৬ টি উপজেলার ২.৪৫ লক্ষ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।২০০৪ সালের আগাম বন্যায় সিলেটের হাওড় অঞ্চলে ব্যাপক পরিমাণ বোরো ধানের ক্ষতি হয়। তাছাড়া জুলাই সেপ্টেম্বর ২০০৪ সালের বন্যায় দেশের ৫৬ টি জেলার ১৪.১২ লক্ষ্য হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়।
১১/কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও শস্যরোগ
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও শস্যরোগ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে হবে। পঙ্গপাল ও অন্যান্য কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও নানাবিধ রোগে বাংলাদেশের ফসল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের ফসলের প্রায় শতকরা ১০ ভাগ বিভিন্ন কীটপতঙ্গের আক্রমণ ও শস্যরোগে নষ্ট হয় বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
১২/ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষির আরেকটি সমস্যা হলো ত্রুটিপূর্ণ ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা। জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ হলেও বাংলাদেশের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা এখনো ত্রুটিপূর্ণ। যারা কৃষির সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্ট তাদের নিজস্ব কোন জমি নেই। তারা বর্গাদার হিসেবে কৃষি কাজ পরিচালনা করে। তাই তারা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির কোন চেষ্টা করে না।
১৩/মূলধনের অভাব
মূলধনের অভাব বাংলাদেশের কৃষকদের অন্যতম সমস্যা। এ সমস্যার কারণে কৃষক আধুনিক যন্ত্রপাতি উন্নতমানের বীজ ও কীটনাশক সংগ্রহ করতে পারে না। ফলে কৃষির উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে মূলধন গঠন খুবই কষ্টকর।
১৪/অশিক্ষিত কৃষক
বাংলাদেশের কৃষকরা অধিকাংশই অশিক্ষিত। তাই তারা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধিতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন। ফলে কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতাও কম। যদিও কতিপয় শিক্ষিত কৃষক রয়েছে, কিন্তু তারা আবার কারিগরি শিক্ষায় অজ্ঞ।
১৫/কৃষিঋণের অভাব
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই কৃষকদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়নের জন্য কৃষি ঋণের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কৃষি ঋণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এ দেশে নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের যে ব্যবস্থা রয়েছে তা প্রয়োজনে তুলনায় খুবই কম। তাই কৃষকরা বাধ্য হয়ে গ্রাম্য মহাজনদের নিকট থেকে চরা সুদের ঋণ গ্রহণ করে থাকে। তাই কৃষি উন্নয়নের জন্য সরকারকে স্বল্প সুদে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত।
১৬/দুর্বল ও অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষকরা অনাহার-অর্ধাহারে দিন অতিবাহিত করে। ফলে তারা দুর্বল ও শীর্ণ দেহের অধিকারী। তাই তারা কৃষি খামারে দক্ষ ও পর্যাপ্ত শ্রমশক্তি দিয়ে কাজ করতে পারে না। আবার অনেক অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক আছে তারাও অদক্ষ। ফলে কৃষি উন্নয়ন ব্যাহত হতে বাধ্য।
১৭/ত্রুটিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষিজাত পণ্যের বাজার অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ। দালাল,ফড়িয়া, আড়তদার প্রভৃতি মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। তাই কৃষকরা উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহ হারায়।
১৮/দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতন
দ্রব্যমূল্যের অস্থিতিশীলতার কারণে কৃষকরা কৃষিপণ্য উৎপাদন করার কোন উৎসাহ পায় না। এমনকি দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতন হলে কৃষকদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। বাজারে দ্রব্যমূল্য অস্থিতিশীল থাকায় কৃষকদের পণ্যের মূল্য যথার্থ না হওয়ায় তারা উৎপাদনে বিমুখ হয়ে পড়ে।
১৯/কৃষি যৌথকরণ ব্যবস্থার অভাব
বাংলাদেশের কৃষকের কোন সংগঠন বা যৌথকরণ ব্যবস্থা নেই বলে তারা যৌথ খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষিতে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। অথচ চীন, রাশিয়া, জাপান, প্রভৃতি দেশ এ ধরনের কৃষি যৌথকরণ ব্যবস্থার দ্বারা সাফল্য অর্জন করছে।
২০/অধিক জনসংখ্যা ও জন্মহার বৃদ্ধি
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই অধিক জনসংখ্যা ও জন্মহার বৃদ্ধি রোধ করতে হবে। বাংলাদেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির হার তার চেয়ে অনেক কম। ফলে বেকারত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি কৃষি উৎপাদনে বিপরীত প্রতিক্রিয়াও সৃষ্টি হচ্ছে।
এছাড়াও বিপুল জনসংখ্যার বাসস্থান তৈরিতে প্রচুর পরিমাণ জমি ব্যবহৃত হওয়ায় কৃষি জমির পরিমাণ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। অধিক জনসংখ্যা ও অত্যাধিক জন্মহারই মূলত বাংলাদেশের প্রথম ও প্রধান সমস্যা। উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.৪২% এবং প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ৯৫৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
২১/অজ্ঞতা ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে গতানুগতিক প্রথার কৃষি পদ্ধতিকে রপ্ত করে। তাই তাদের মধ্যে আধুনিক কৃষি জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অন্যদিকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা রক্ষণশীল বলে আধুনিক কৃষি পদ্ধতিকে তারা সহজে গ্রহণ করতে চায় না।
বাংলাদেশের কৃষি সমস্যার সমাধান
বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা এতই প্রকট যে, এ সমস্যাগুলো নিরসন করা অপরিহার্য। কারণ বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের হাসি-কান্না, সুখ দুঃখ কৃষির সাথে জড়িত। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো কৃষির উন্নয়ন। অধিক খাদ্য ফলাও' ও 'সবুজ বিপ্লব' কর্মসূচি গ্রহণ করায় কৃষির গুরুত্ব সহজেই অনুধাবন করা যায়। কৃষির সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে:
১/আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ
বাংলাদেশে কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করতে হবে। এক্ষেত্রে ট্রাক্টর, শক্তি চালিত পাম্প, বুলডোজার প্রভৃতি আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রচলন করে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। এতে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
২/উত্তম বীজ ও সার সরবরাহ
উত্তম বীজ ও সার কৃষকদের নিয়মিত সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে কৃষকদের উন্নত মানের বীজ ও পর্যাপ্ত পরিমাণে রাসায়নিক সার সরবরাহ করতে হবে। এতে জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি সহ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।
৩/জমি একত্রীকরণ
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই জমি একত্রীকরণ করতে হবে। বাংলাদেশের জমিগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাগে বিভক্ত। কৃষি সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হলো জমি একত্রীকরণ। এদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকানা ভিত্তিক জমিগুলো সমবায় সমিতির মাধ্যমে একত্র করে এবং আইল ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে জমির ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়।
৪/মূলধন ও ঋণ সরবরাহ
কৃষিখাতকে উন্নত করার জন্য কৃষকদের স্বল্পমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি সহজ শর্তে ঋণ প্রদান এবং মূলধনের যোগান নিশ্চিত করতে হবে।ফলে কৃষকরা কৃষি কাজে উৎসাহিত হবে। আর এতে করে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৫/সেচব্যবস্থার উন্নয়ন
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার হাত থেকে কৃষিকে রক্ষা করতে হলে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। কারণ শুধুমাত্র বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করে কৃষির উন্নতি কখনো সম্ভব নয়। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা সমাধান করতে হলে সেচব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
৬/শিক্ষাবিস্তার
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক অশিক্ষিত। তাই আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে তারা অজ্ঞ। অশিক্ষিত কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তি ও চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য কৃষি বিষয়ক শিক্ষার সম্প্রসারণ করতে হবে। এতে কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৭/বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন
কৃষকরা যাতে তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পায় সেজন্য বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে সুষ্ঠু বিক্রয় নীতিমালা, মধ্যস্বত্বভোগীদের উৎখাত, পণ্যের মান নির্ধারণ এবং গ্রেডিং স্কীম প্রবর্তন প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
৮/প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যার হাত থেকে কৃষি ফসল রক্ষা করতে হলে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করতে হবে। তাছাড়া বনজ সম্পদ সংরক্ষণ করেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধ করা যায়।
৯/পতিত জমি উদ্ধার
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক খাস ও পতিত জমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কতিপয় প্রভাবশালী মহলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এসব জমিগুলো উদ্ধার ও সংস্কার করে ভূমিহীন সমবায় সমিতির হাতে অর্পণ করতে হবে। এ ব্যবস্থায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
১০/আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন
বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থার উন্নতির জন্য আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন করা যায়। এতে কৃষকরা অধিক ফসল ফলাতে উৎসাহিত হবে এবং দেশের কৃষি উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই আদর্শ কৃষি খামার স্থাপন করা অতি জরুরী।
১১/কৃষি গবেষণা
বাংলাদেশের কৃষিপণ্যের মান উন্নত করতে হলে কৃষি গবেষণাগার স্থাপন করতে হবে। আর বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে গবেষণাগারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কৃষিপণ্যের মান ও ফলন বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।
১২/ভূমি আইনের সংস্কার
সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বর্তমান ভূমি আইনের সংস্কার সাধন করতে হবে। এক্ষেত্রে আইন পাস করে জমির উপরিভাগ,খন্ডিকরণ রোধ করে কৃষকদের জমি একত্রীকরণে রাজি করতে হবে। একত্রিত জমিতে আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা হলে কৃষি উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
১৩/কৃষি প্রদর্শনী
কৃষির উন্নতির জন্য কৃষি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে আদর্শ কৃষকদের পুরস্কৃত করলে কৃষকরা কাজে উৎসাহ পাবে। ফলে কৃষির উন্নতি ঘটবে। সুতরাং বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হলে কৃষি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
১৪/কীটনাশক সরবরাহ
পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় কীটনাশক সরবরাহ করতে হবে। এক্ষেত্রে কৃষকদের স্বল্প মূল্যে ও সহজ শর্তে কীটনাশক সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫/পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়ন পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। তাই কৃষির উপকরণ ও কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য উন্নত যাতায়াত ও পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
১৬/ভূমির ক্ষয়রোধ
ভূমিক্ষয়ের কারণে কৃষি জমির উর্বরতা কমে যায়। ফলে কৃষির উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য ভূমির ক্ষয়রোধ করতে হবে। ফলে কৃষির উন্নতি ঘটবে।
১৭/সমবায় কৃষি প্রচলন
কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য সমবায় কৃষির প্রচলন করতে হবে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী কৃষকদের বিচ্ছিন্ন ও খন্ডিত জমিগুলো একত্রিত করে চাষের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এটা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
১৮/জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দূরীকরণ
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান করতে চাইলে অবশ্যই জমির জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা দূরীকরণ করতে হবে।এ জন্য বিল,হাওড় প্রভৃতি জলাবদ্ধতা এলাকা পানি নিষ্কাশনের মাধ্যমে চাষের আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া সমুদ্রপকূলীয় এলাকায় কৃষি জমির লবণাক্ততা দূরীকরণে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
১৯/গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায় হলো গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা। কেননা কৃষিজ পণ্য সারা বছর ব্যবহারের জন্য গুদামজাতকরণ করতে হয়। আর এজন্য প্রয়োজনে হিমাগার, সংরক্ষণাগার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
২০/খামার পদ্ধতি
বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা সমাধানের আরেকটি উপায় হলো খামার পদ্ধতি। কেননা খামার ব্যবস্থায় কৃষি উপকরণ কাম্য মাত্রায় ব্যবহার করা যায়। তাই কৃষি ব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণ করার জন্য খামার পদ্ধতিতে চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
২১/প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা
বাংলাদেশের কৃষি সমস্যা সমাধান করতে হলে কৃষকদের কৃষি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কৃষক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কৃষিকাজ সম্পাদন করতে পারে। এতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
২২/সরকারি প্রচেষ্টা
বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক দরিদ্র। ফলে প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে তাদের পক্ষে সুষ্ঠুভাবে কৃষি কাজ করা সম্ভব হয় না। এমতাবস্থায় সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার বিনামূল্যে কৃষির প্রয়োজনীয় উপকরণ বিশেষ করে সার, বীজ,কীটনাশক ইত্যাদি সরবরাহ করতে পারে।
শেষ কথা
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের বিরাজমান কৃষি সমস্যাগুলো সঠিক বাস্তবসম্মত সমাধান করা গেলে এ দেশ সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হবে। এরূপ ধারণার ভিত্তিতে ১৯৯৯ সালে জাতীয় কৃষি নীতি'প্রণীত হয়। বর্তমানে এ নীতির আওতায় দেশের কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ফলে কৃষি সমস্যা অনেকাংশে দূর করা সম্ভব হচ্ছে। আজকের আর্টিকেলে বাংলাদেশের কৃষির সমস্যা ও সমাধান বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।