প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা কর
প্রিয় পাঠক আপনি কি জানেন প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলো সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভূপ্রকৃতি,জলবায়ু,মৃত্তিকা,পানি প্রভৃতির বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়।আর প্রকৃতির এই বৈচিত্রতার কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রাণীর বৈচিত্র্যতা লক্ষণীয়।
আজকের আর্টিকেলে প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর বিবরণ
বর্তমানে প্রচলিত প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল সমূহ হল:
১) পেলি আর্কটিক অঞ্চল:হিমালয় পর্বতমালার উত্তরে এশিয়া ও ইউরোপ;
২)নি.আর্কটিক: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা;
৩) নিওট্রাপিক্যাল: ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার অধিকাংশ;
৪) ওরিয়েন্টাল: হিমালয়ের দক্ষিণে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া;
৫) ইথিওপিয়ান অঞ্চল: আষ্ট্রেলিয়া ও নিকটবর্তী দীপাঞ্চল।
৬)অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চল।
১) পেলি আর্কটিক অঞ্চল
প্রাণী ভূগোলের শ্রেণিকরণে এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ প্রাণী অঞ্চল।আইসল্যান্ড,ইউরোপ,ভূমধ্যসাগরীয়,আফ্রিকা,আরব উপদ্বীপের উত্তরাংশ, সাইবেরিয়া, চীন, জাপান, মধ্য এশিয়া ও তিব্বত এই অঞ্চলভূক্ত।পেলি আর্কটিকের উপঅঞ্চলগুলি হল ইউরোপিয়ান (মধ্য ও উত্তর ইউরোপ), ভূমধ্যসাগরীয় (দক্ষিণ ইউরোপ ও ভূমধ্যসাগরীয় আফ্রিকা)সাইবেরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ান।
এ অঞ্চলের প্রাণী
অঞ্চলটিতে ১৭ গোত্রের ২৮ টি গণভূক্ত স্বাদু পানির মাছ, লেজযুক্ত বিভিন্ন প্রকার উভচর,লেজমুক্ত উভচর,১৮টি গোত্রের সরীসৃপ ও ৩৫ গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। এছাড়া পাখি আছে ৫৩ টি গোত্রের। সমিষ্টিকভাবে উল্লেখযোগ্য প্রাণীগুলি হলো স্যালামান্ডার (লেজযুক্ত দৈত্যাকার উভচর), বিভিন্ন প্রকার ব্যাঙ, কচ্ছপ, টিকটিকি, কুমির,ভাইপার সাপ, কুকুর, খরগোশ, ভাল্লুক, কাঠবিড়ালী, হরিণ, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, হায়েনা, ইত্যাদি।মাছের মধ্যে এসপার,এসপিয়াস,কম্পহোরাস, ,টেলিয়া,টেনকা,পার্করিনা প্রভৃতি প্রধান।
২) নি. আর্কটিক অঞ্চল
কর্কট ক্রান্তির উত্তরে উত্তর আমেরিকা ও গ্রিনল্যান্ড এই প্রাণী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। উত্তর আমেরিকার উত্তরাংশ, ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চল,রকি পার্বত্য অঞ্চল, অ্যাপিলিশিয়ান অঞ্চল, বৃহৎ সমভূমি, গ্রিনল্যান্ড প্রভৃতি এটির উপ অঞ্চলভুক্ত।
এই অঞ্চলের প্রাণী
নি.আর্কটিক অঞ্চলে ৪৯ টি গোত্রভূক্ত পাখি দেখা যায়।পেলিক্যান,শকুন, বাজ, ঈগল,মকিং বার্ড, বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, থ্রাস, পেঁচা, তোতা, হামিং বার্ড,ফ্লেমিঙ্গো প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য পক্ষী প্রজাতি। স্তন্যপায়ী প্রাণীর ২৪ টির মত গোত্র নি. আর্কটিক অঞ্চলে সনাক্ত করা গেছে। তন্মধ্যে অপোসাম,আর্মাডিলো, চামরী গরু, গরু, এন্টেলোপ, হরিণ, খরগোশ, নেকড়ে, ভাল্লুক, খেকশিয়াল, কুকুর, বিড়াল ও ৪টি প্রজাতির বাদুড় উল্লেখযোগ্য। উভচর প্রাণীর ১৪ টি গোত্র এই প্রাণী অঞ্চলে দেখা যায়।
তিন প্রজাতির ব্যাঙ ও লেজযুক্ত স্যালমান্ডারের প্রায় সব প্রজাতির এখানে সনাক্তকৃত হয়েছে। সরীসৃপের ২১ টি গোত্র অঞ্চলটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। লিজার্ড, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও কাছিম (কচ্ছপ),গেকো ও ২টি প্রজাতির কুমির এ অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য সরীসৃপ।নি-আর্কটিক প্রাণী অহ চলে ২৯ গোত্রের স্বাদু পানির মাছ রয়েছে।গারপাইক,বোফিন, ক্যাটফিশ,মুনআই,কেভফিশ,বস,হোয়াইট ফিশ, ব্লাক ফিশ, পাইক, সালমন প্রভৃতি এ অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য মৎস্য প্রজাতি।
৩)নিওট্রাপিক্যাল অঞ্চল
মধ্য আমেরিকা,ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ ও দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ে নিওট্রাপিক্যাল প্রাণী অঞ্চল গঠিত।এর চারটি উপ অঞ্চল চিলিয়ান, ব্রাজিলিয়ান, মেক্সিকান (মধ্য আমেরিকা) ও এস্টিচলিয়ান (ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ) বিদ্যমান।প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর মধ্যে নিওট্রাপিক্যাল অঞ্চলে অধিক প্রাণীর বৈচিত্রতা লক্ষ করা যায়।
এই অঞ্চলের প্রাণী
সমগ্র অঞ্চলটি প্রাণীকুল সমৃদ্ধ। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সরীসৃপ, উভচর,স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পক্ষী দেখা যায়। নিরক্ষীয় আমাজান বনভূমি এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় প্রাণীকুলের অন্যতম ক্ষেত্র।নিওট্রাপিক্যাল অঞ্চলে ৩২ টির মত স্থলচর স্তন্যপায়ী গোত্রের ১০৩ গণভুক্ত প্রাণী বিদ্যমান।অপোসাম, গিনিপিগ, আর্মাডিলা, টাপির, কাঠবিড়ালী, উট, হরিণ, পার্কুপাইন,লামা, ভাল্লুক, কাটা ইঁদুর, মার্সুপিয়াল প্রভৃতি স্তন্যপায়ী প্রাণী সচরাচর দেখা যায়। এই প্রাণী অঞ্চলটি যথেষ্ট পাখি সমৃদ্ধ।
এছাড়াও ৬৭ গোত্রের ৬০০ টি গনের পক্ষীকুলের আবাসভূমি এটি। পেঙ্গুইন, উইভার বার্ড,ওয়েল বার্ড,পাফবার্ড,সোয়ালা, শকুন, গুয়ান, মটমট ইত্যাদি প্রজাতিগুলি বিশেষ পরিচিত।নিওট্রাপিক্যাল অঞ্চলে লেজবিহীন,পা বিহীন ও লেজ যুক্ত ১০ টি গোত্রের উভচর দেখা যায়। এখানে ৮টি গোত্রের লিজার্ড, ৮ টি গোত্রের কচ্ছপ, কুমিরের ২টি গোত্র ও সাপের ৭টি গোত্র সনাক্ত হয়েছে। স্বাদু পানির মাছ এ অঞ্চলটি অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় কম সমৃদ্ধ। মাত্র ৩টি বর্গের সাধু পানির মৎস্য পাওয়া যায় এখানে।
৪) ইথিওপিয়ান অঞ্চল
কর্কট ক্রান্তির দক্ষিণে সমগ্র আফ্রিকা মহাদেশ,আরবের আরবের দক্ষিণাংশ এবং মাদাগাস্কার-মরিশাসসহ কয়েকটি দ্বীপাঞ্চল নিয়ে এই অঞ্চলটি গঠিত।
এই অঞ্চলের প্রাণী
এ অঞ্চলটিতে ৬৭ গোত্রের পাখি ও ৩৮ গোত্রের স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং ২৯ টি গোত্রের সরীসৃপ রয়েছে। উভচর প্রাণীও ১০ টির মত গোত্র সনাক্তকৃত হয়েছে। বিভিন্ন গোত্রের স্বাদু পানির মাছও রয়েছে অঞ্চলটিতে।এ অঞ্চলের পক্ষীকুলের মধ্যে কাকাতুয়া, সোয়ালো, উয়েভার,উটপাখি, শ্রাইক, ছাগলচোষা,বাজপাখি,পেঁচা, বিভিন্ন প্রজাতির বক, সারস,ষ্টারলি প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে শিম্পাঞ্জী,গরিলা, বের্বুন, বিভিন্ন প্রজাতির বানর, গিবন, হায়েনা, জিরাফ, জেব্রা, ওরাং ওটাং, লেমুর, হাতি, বাঘ, সিংহ, ইঁদুরের বিভিন্ন প্রজাতি ও বিষাক্ত বাদুড় অন্যতম।২২ টি সরীসৃপ গোত্রের মধ্যে ৪টি কচ্ছপের,৭টি সাপের,১টি কুমিরের ও ১০ টি লিজার্ডের। উভচরের মধ্যে ৮টি গোত্রভুক্ত ৪০ টি গনের ব্যাঙ সনাক্তকৃত হয়েছে।ইথিওপিয়ান অঞ্চলকে অনেকে পূর্ব আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা,দক্ষিণ আফ্রিকা, মালাগাছি, দক্ষিণ আরব ইত্যাদি উপ বিভাগে বিভক্ত করেন।
৫) ওরিয়েন্টাল অঞ্চল
হিমালয়ের দক্ষিণে নেপাল,ভুটান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা,মিয়ানমার,থাইল্যান্ড,মালয়েশিয়া,ইন্দোচীন, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া এই অঞ্চলভুক্ত। সমগ্র অঞ্চলটি ভারত, শ্রীলংকা, ইন্দোচীন ও মালয় উপ অঞ্চলে বিভক্ত।
এই অঞ্চলের প্রাণী
প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর মধ্যে ওরিয়েন্টাল অঞ্চল প্রাণী সমূহে ভরপুর।ওরিয়েন্টাল অঞ্চলে ২৯ গোত্রের সরীসৃপ,৯ গোত্রের উভচর,৩১ টি গোত্রের স্তন্যপায়ী,৬৬ গোত্রের পাখি ও ২৩ গোত্রের স্বাদু পানির মাছ পাওয়া যায়।স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ১৮ টি প্রজাতির শজারু,সিভিট বা গন্ধাগোকুলের বিভিন্ন প্রজাতি, গিবন, হাতি,শৃগাল,নেকড়ে,বিভিন্ন প্রজাতির ভাল্লুক, বানর, হনুমান,কুকুর,বিড়াল,ইঁদুর,বাগডাশা রয়েছে।
এছাড়াও এখানে রয়েছে হরিণের অনেকগুলি প্রজাতি, ভাল্লুক, বানর, হনুমান,কাঠবিড়ালী,গয়াল,গন্ডার বাইসন,গরু,মহিষ,উট বিভিন্ন প্রজাতির ছাগল,বাঘ,চিতাবাঘ,খচ্চর,গাধা,ঘোড়া, প্রভৃতি নানাবিধ বন্য প্রাণীর সমাহার দেখা যায়।সুমাত্রা-জাভাতে ওরাংওটাং ও শিম্পাঞ্জী পাওয়া যায়। সরীসৃপের মধ্যে ২টি গোত্রের কুমির, কচ্ছপ ও ১০ টি গোত্রের লিজার্ড এ অঞ্চলে সনাক্তকৃত হয়েছে।
ওরিয়েন্টাল অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ রয়েছে।গোখরো,পদ্মা গোখরো,কেউটে,কালনাগিনি,দুধরাজ, ধনরাজ,মেটে সাপ,দারাশ, চন্দ্রবোড়া, সরু প্রবাল সাপ, গুইসাপ, ধোঁড়াসাপ, শঙ্খচুড়, গোলবাহার,ও একাধিক প্রজাতির অজগর সনাক্তকৃত হয়েছে এই প্রাণী অঞ্চলে।স্বাদু পানির মাছের ১২টি গোত্র আছে ওরিয়েন্টাল অঞ্চলে।
৬) অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চল
অস্ট্রেলিয়া,নিউজিল্যান্ড, নিউ গিনি, ফিজি,সলোমন দ্বীপপুঞ্জ,পলিনেশিয়া প্রভৃতি অস্ট্রেলিয়ান প্রাণী অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত।প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলোর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চল অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এই অঞ্চলের প্রাণী
এই প্রাণী অঞ্চলে ৯ গোত্রের স্তন্যপায়ী, ১৬ গোত্রের সরীসৃপ,৫৮ গোত্রের পাখি, ৫ গোত্রের উভচর ও ১৫ গোত্রের স্বাদু পানির মাছ বিদ্যমান। পুরো অঞ্চলটির চারটি উপ অঞ্চল রয়েছে যেমন: মালয় অস্ট্রেলিয়ান (নিউগিনি ও পার্শ্ববর্তী দ্বীপমালা), অস্ট্রেলিয়ান (অস্ট্রেলিয়া মূল ভূ-খণ্ড ও সুমাত্রা), পলিনেশিয়া উপ অঞ্চল (ফিজি ও অন্যান্য নিকটবর্তী দ্বীপাঞ্চল) ও নিউজিল্যান্ড উপ অঞ্চল।
অস্ট্রেলিয়ান অঞ্চলের স্তন্যপায়ী প্রাণীকুলের মধ্যে ক্যাঙ্গারু,প্লাটিপাস,অপোসাম,মোলস,মার্সুপিয়াল ইত্যাদি প্রজাতির এবং বাদুড়ের ২৮ টি গন সনাক্ত হয়েছে। অঞ্চলটিতে বিদ্যমান পক্ষীকুলের মধ্যে হিরণ,পেঙ্গুইন হাঁস,বক,ঈগল, কাকাতুয়া, কাক, টিয়া ও উইভবার্ড উল্লেখযোগ্য।৫টি উভচর গোত্রের লেজবিহীন প্রজাতি এ অঞ্চলে বিদ্যমান।সরীসৃপের মধ্যে ১গোত্রের কুমির,৩ গোত্রের কচ্ছপ,৬ গোত্রের টিকটিকি ও ৫ গোত্রের সাপ রয়েছে। স্বাদু পানির মাছ গুলির মধ্যে বাইম, সিলভার সাইড,ক্যাটফিস ও ফুসফুস মাছের আধিক্য দেখা যায়।
শেষ কথা
বিশ্ব প্রাণী বিন্যাস সমস্বত্বভাবে হয়নি। এটা নির্ভর করে কতকগুলি জৈব ও অজৈব নিয়ামকের উপর (জৈব নিয়ামক,অজৈব উপাদান,জলবায়ু,ভূপ্রকৃতি ও মৃত্তিকা)। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য,পৃথিবীর অনেক প্রাণীর আবাস সরাসরি উদ্ভিজ্জের দ্বারা প্রভাবিত। সে ক্ষেত্রে বিশেষ শ্রেণীর উদ্ভিজ্জমন্ডলে যেসব প্রাণী বিকশিত হয়,ঐ শ্রেণীর উদ্ভিজ্জ জন্মানোর অনুকূল অবস্থা সমূহ প্রাণীকুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ প্রাণী ও উদ্ভিজ্জের বিন্যাসের নিয়ামক সমূহ অনেক ক্ষেত্রে এক।আজকের আর্টিকেলে প্রাণী ভৌগোলিক অঞ্চল গুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।