পানি চক্র বলতে কি বুঝ-পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো বর্ণনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি পানি চক্র বলতে কি বুঝ-পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে পানি চক্র বলতে কি বুঝ-পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন। সহজ ভাবে বলা যায়, মহাসাগর ও অন্যান্য জলাধার থেকে বায়ুমণ্ডল এবং সেখান থেকে পুনরায় ভূমি হয়ে মহাসাগরে পানি ফিরে আসাকে পানি চক্র বলা হয়।
পানি চক্র বলতে বোঝায় মূলত বায়ুমণ্ডল,ভূমি এবং মহাসাগর ও অন্যান্য জলাধারের মধ্যে ক্রমাগতভাবে পানি চক্রাকারে আবর্তন। আজকের আর্টিকেলে পানি চক্র বলতে কি বুঝ-পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
পানি চক্র
পৃথিবীপৃষ্ঠে সমুদ্র ও মহাদেশ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে আছে। উত্তর গোলার্ধে মোট আয়তনের শতকরা ৩৯ ভাগ স্থল ও ৬১ ভাগ জল,আর দক্ষিণ গোলার্ধ শতকরা ১৯ ভাগ স্থল আর ৮১ ভাগ জল। কাজেই উত্তর গোলার্ধকে স্থল গোলার্ধ বললে দক্ষিণ গোলার্ধকে জল গোলার্ধ বলা চলে।আর পৃথিবীর সমস্ত জলভাগের ৯৭% জলই হচ্ছে সমুদ্রের পানি বা নোনা পানি, আর বাকি ৩% হচ্ছে মিষ্টি পানি।
সূর্যের তাপে সমুদ্র,হ্রদ,নদ-নদী ও অন্যান্য জলাশয় এবং উদ্ভিজ্জের পানি বাষ্পের পরিণত হয়ে উপরে উঠে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে ক্রমান্বয়ে ঠান্ডা হতে থাকে। পরে ঠান্ডা জলীয় বাষ্প ক্রমশ ঘণীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয়। মেঘের পানি কণাগুলো যখন বড় বড় কণায় পরিণত হয় তখন পৃথিবীর পৃষ্ঠটানে ভূপৃষ্ঠে বৃষ্টিরূপে বা তুষার ও বরফ আকারে পড়তে থাকে।এভাবে বিভিন্ন উৎস স্থল থেকে পানি বিভিন্ন রূপান্তরের মাধ্যমে স্থানান্তর হয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আবার যথাস্থানে ফিরে আসলে তাকে পানি চক্র বলে।
সহজ ভাবে বলা যায়,পানি চক্রের নিয়ন্ত্রক হলো সূর্য। সূর্যতাপে মহাসাগর ও অন্যান্য জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমণ্ডলে যায় এবং সেখান থেকে ঘনীভবনের ফলে সৃষ্ট মেঘ ও তৎসৃষ্ট বৃষ্টিপাত বা অন্যপ্রকার বারিপাতের (তুহিন,তুষার,শিশির কুয়াশা,শিলাবৃষ্টি) মাধ্যমে সরাসরি অথবা ভূমিভাগ হয়ে পুনরায় মহাসাগর ও অন্যান্য জলাশয় ফিরে আসে। এটা একটা অবিরত চলমান প্রক্রিয়া এবং তা' পানি চক্র বা বারি চক্র নামে অভিহিত।
পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদান
পানি চক্রের সংজ্ঞাগুলো থেকে বুঝা যায় যে,পানি চক্রের পিছনে কয়েকটি প্রক্রিয়া শক্তি হিসেবে কাজ করে। আর এই শক্তিগুলোকেই পানি চক্রের গঠনকারী উপাদান বলা হয়। নিম্নে পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো বর্ণনা করা হলো:
- বাষ্পীভবন
- ঘনীভবন
- অধ:ক্ষেপন
- রোধন
- আত্নভূতকরণ
- বাষ্পীপ্রস্বেদন
- চোয়ানো বা অনুপ্রবেশ
- মাটির স্তরে পানি সঞ্চয়
- অনুস্রাবণ
- ভূ-গর্ভস্থ পানি
- ভৌত পানি
১/বাস্পীভবন
পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলোর মধ্যে বাষ্পীভবন অন্যতম।বাষ্পীভবন হলো বিভিন্ন ভৌত প্রক্রিয়ার দ্বারা সমুদ্র, নদ-নদী বা অন্যান্য জলাশয়,ভূপৃষ্ঠ ও উদ্ভিদ থেকে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে বায়ুমন্ডলে স্থানান্তরিত হওয়া। বায়ুমন্ডলে বাষ্পীভবনের শতকরা ৮৪ ভাগ আসে সমুদ্র থেকে এবং ১৬ ভাগ আসে অন্যান্য উৎস থেকে।বায়ুমণ্ডলের বাষ্পীভবন শীতল ও ঘনীভূত হয়ে জল কণার আকার ধারণ করে অবশেষে বারিপাত ঘটায়।
২/ঘনীভবন
বায়ুমণ্ডলে ভাসমান পানি কণার বা বরফ কনার রূপান্তর প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন বলে। বায়ুর আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও শীতলতার পরিমানের উপর ঘনীভবন নির্ভর করে। বায়ুর তাপমাত্রা শিশিরাংকের বা হিমাংকের নিচে নেমে গেলে ঐ তাপে বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং এই অতিরিক্ত জলীয়বাষ্প,পানি কণা ও বরফ কণা হিসেবে ঘণীভূত হয়। ঘনীভবন প্রক্রিয়ায় মেঘ বৃষ্টি কণা, তুষার কণা, প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
৩/অধ:ক্ষেপন বা বারিপাত
জলীয়বাষ্প শীতল বায়ুর সংস্পর্শে এসে শিশিরাংকে পৌঁছে বায়ুমণ্ডলের ধূলিকণাকে আশ্রয় করে সহজেই ঘনীভূত হয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায় পরিণত হয়। জলকণাগুলো পরে বড় বড় ফোঁটায় রূপ লাভ করলে মাধ্যকর্ষণ শক্তির প্রভাবে ভূপৃষ্ঠে পতিত হলে তখন তাকে অধ:ক্ষেপন বলে। বৃষ্টিপাত, শিলাবৃষ্টি, তুষারপাত ইত্যাদি বারিপাতের অন্তর্ভুক্ত। কুয়াশা,শিশির,তুহিন ঝড়ে পড়ে না বলে এগুলিকে অনেকে অধ:ক্ষেপনের বাহিরে গণ্য করেন।
৪/রোধন
পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদান গুলোর মধ্যে রোধন এর গুরুত্ব অপরিসীম।বৃষ্টির পানি ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হওয়ার সময় উদ্ভিদ,দালান-কোঠা,ঘর-বাড়ি ইত্যাদি দ্বারা বাধা প্রাপ্ত হওয়াকে রোধন বলে। বর্ষিত পদার্থ রোধিত হওয়ার পর কিছু অংশ জলীয়বাষ্পে পরিণত হয় এবং অবশিষ্টাংশ ভূপৃষ্ঠে পতিত হয়।
৫/আত্নভূতকরণ
বৃষ্টির পানির কিছু অংশ ভূপৃষ্ঠের মাটি কণা গুলোর মধ্যে আত্মভূত হয়। যার ফলে মাটি আর্দ্র হয়। আত্নভূত হওয়ার অবশিষ্ট পানি পাতলা ও হালকা পৃষ্ঠপানি সরণ আকারে ভূমির ঢাল অনুসারে প্রবাহিত হয়।
৬/বাষ্পীয় প্রস্বেদন
সাগর ও অন্যান্য জলাশয় থেকে সূর্য তাপে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বায়ুমন্ডলে উঠে যায়। আবার উদ্ভিদ শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে যে পানি শোষণ করে কান্ড,ডাল ও পাতায় পাঠিয়ে দেয় তা সূর্য তাপের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে দেয় আর একেই প্রস্বেদন বলে। আর বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের মিলিত প্রচেষ্টায় বায়ুমণ্ডলে যে জলীয়বাষ্প তৈরি হয় তাকে বাষ্পীয় প্রস্বেদন বলা হয়।
৭/চোয়ানো বা অনুপ্রবেশ
বারিপাতের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের যে পানি এসে পৌঁছে তা মাটির প্রবেশ্য স্তরের মধ্য দিয়ে চুঁইয়ে নিচের দিকে যায়। পরে প্রবেশ্য স্তরের ঢাল অনুসারে গড়িয়ে গড়িয়ে প্রবাহিত হয়। এই প্রবাহিত পানি পরবর্তীতে ঝর্ণা আকারে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে আসে এবং নদীর মাধ্যমে সাগরে পৌঁছে পানি চক্রের সহায়তা করে।
৮/মাটিতে পানি সঞ্চয়
চোয়ানো প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট পানি মাটির বিভিন্ন কণার মধ্যবর্তী রন্ধ্রপরিসরে বা ব্যবধানে সঞ্চিত হয়। এরপর অতিরিক্ত পানি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে অন্ত:প্রবাহ আকারে মাটির স্তরের ঢাল অনুসারে নিচের দিকে প্রবাহিত হয়।
৯/অনুস্রাবণ
চোয়ানো প্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশকারী পানি প্রথমে মাটিকে আর্দ্র করে এবং মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে মাটির অধিকতর গভীর স্তরগুলোর ছোট এবং সূক্ষ্ম রন্ধ্রপরিসরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে থাকে। পানির অনুপ্রবেশের এই প্রক্রিয়াকে অনুস্রাবণ বলে।
১০/ভূগর্ভস্থ পানি
ভূগর্ভস্থ পানি হলো সেই পানি যা ভূপৃষ্ঠের নিচে বিশেষ গভীরতায় বিভিন্ন শিলাস্তরে সঞ্চিত থাকে। ভূ-গর্ভে শিলাস্থিত ফাটল ও ছিদ্র সমূহে এবং জমাটহীন তলানীর মধ্যে পানি চক্রের এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে এই ভূ-গর্ভস্থ পানি।
১১/ভৌত পানি
মাটির অধিক গভীরে বিশাল পানি ভান্ডারে পানি সঞ্চিত আছে। বর্ষাকালে অনুপ্রবেশ ও অনুস্রাবণের মাধ্যমে যখন অতিরিক্ত পরিমানে পানি এই ভান্ডারে আসে তখন তা গড়িয়ে পানি সরণ সৃষ্টি করে এবং ভূপৃষ্ঠে বা সমুদ্রে প্রবাহিত হয়।
শেষ কথা:পানি চক্র
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, পানি যে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে পুনরায় তার উৎস স্থলে ফিরে আসলে তাই হল পানি চক্র। আর এই পর্যায়গুলো কিভাবে পানি চক্রকে সহায়তা করে বা পানিরচক্র সংঘঠনে প্রভাব বিস্তার করে তা ইতিমধ্যেই উপরে আলোচিত হয়েছে। পানির চক্রের এই গঠন প্রক্রিয়া জীবজগতের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। পানি চক্রের দ্বারা অব্যাহত আছে বলেই ভূপৃষ্ঠে বারিমন্ডলের ভারসাম্য বজায় রয়েছে এবং জীব মণ্ডলও তার প্রয়োজন মাফিক পানির চাহিদা মেটাতে পারছে। আজকের আর্টিকেলে পানি চক্র বলতে কি বুঝ-পানি চক্রের বিভিন্ন উপাদানগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।