মানব বসতি কাকে বলে-মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানতে চান মানব বসতি কাকে বলে-মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক গুলো কি। আজকের আর্টিকেলে মানব বসতি এবং এর নিয়ামক সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
মানব বসতি কাকে বলে-মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক আলোচনা কর
মানব বসতি বলতে বোঝায় অনুকূল ও সুবিধা জনক স্থানে বাশগৃহ ও তার আনুসঙ্গিক উপাদান সমূহের নির্দিষ্ট গন্ডীতে বিস্তারের প্রবণতা। এর ফলে বসতির একটা বাহ্যিক রূপ সৃষ্টি হয়, যা ভৌগলিকদের চোখে পড়ে।

মানব বসতি কাকে বলে

বিশ্বের যে সব স্থানে বা পরিসরে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার উপর ভিত্তি করে মানুষ বা কোন জনগোষ্ঠী ঘরবাড়ি নির্মাণ করে আবাসিক জীবন-যাপন করে থাকে,তাকে জনপদ বা জনবসতি বলে।
  • ভূগোলবিদ Smith তার Dictionary of Geography তে মানব বসতির সংজ্ঞা হিসেবে বলেছেন, "মানব বসতি হল স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য তৈরি আবাস স্থল"।তিনি এ বিষয়ে আরো উল্লেখ করেছেন যে,একক আবাস স্থল থেকে গ্রাম, এমনকি মহানগরীও বসতির আওতাভুক্ত হবে।
  • Stone এর মতে, "কোন স্থানে একক বা একের বেশি মানুষের বসবাস করাকে মানব বসতি বা জনপদ বলে"।
  • Dicken and Pitts এর মতে,"ক্ষুদ্র গ্রাম,গ্রাম,শহর ও নগরের মানুষ ও আবাসস্থলের সমষ্টি হল বসতি"।
  • Brunhes এর মতে,"মানুষের দুটো মৌলিক চাহিদা অর্থাৎ বসতগৃহ ও রাজপথের পৃথিবী পৃষ্ঠে বহিঃপ্রকাশ হলো মানব বসতি"।

মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক

মানব বসতির সাথে পরিবেশ ওতোপ্রতভাবে জড়িত। পরিবেশ আবার দুই প্রকার যেমন:১) প্রাকৃতিক পরিবেশ ২) সামাজিক বা সাংস্কৃতিক পরিবেশ। আর এই সব পরিবেশ মানব বসতি গড়ে তুলতে যথেষ্ট অবদান রাখে। নিচে মানব বসতির নিয়ামক বা কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

ক)প্রাকৃতিক নিয়ামক

১)ভূ-প্রকৃতি

মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক গুলোর মধ্যে প্রকৃতির প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ভূ-প্রকৃতি তিন ধরনের রয়েছে। যেমন: পর্বতময় ভুমি,মালভূমি ও সমভূমি।পর্বতময় ভূমির উচ্চতা বেশি হওয়ায় সেখানে তাপ কম, আবার দেখা যায় যে শীতের প্রকোপ বেশি এবং তুষারপাত হয়। উপরন্তু পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বন্ধুর (উঁচু-নিচু) প্রকৃতির। ফলে এসব কারণে পার্বত্য অঞ্চলের মানব বসতি গড়ে উঠে নাই। তবে নাতি দীর্ঘ পর্বতের ঢালে স্বল্প সংখ্যক মানব বসতি গড়ে উঠে। উচ্চ মালভূমি এলাকায় মানব বসতি গড়ে উঠে নাই।

কারণ সেখানেও শীতল আবহাওয়া ও তুষারপাত লক্ষ্য করা যায়। তবে ১৮০০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট মালভূমিগুলোতে মানব বসতি গড়ে উঠেছে। যেমন: ভারতের দাক্ষিণাত্যের মালভূমিতে মানব বসতি গড়ে উঠে। মানব বসতি গড়ে ওঠার পেছনে সমভূমির প্রভাব সবচেয়ে বেশি।পৃথিবীর অধিকাংশ মানব বসতি সমভূমি এলাকায় গড়ে উঠেছে।কারণ সমভূমি অঞ্চলে ফসল উৎপাদন,পানির সহজলভ্যতা রাস্তাঘাট নির্মাণ ইত্যাদি সহজতর হয়। আর এ কারণে সমভূমিতে বিভিন্ন ধরনের মানব বসতি গড়ে উঠেছে।

২)জলবায়ু

মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক গুলোর মধ্যে জলবায়ু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক।উত্তাপ,বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহ জলবায়ুর উপাদান।আর এ উপাদানগুলো বসতির উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। বসতি গড়ে ওঠার পেছনে অধিক উত্তাপ বা অধিক শীত এর কোনটাই অনুকূল নয় বলে বিশ্বের অধিক উষ্ণ বা শীতল অঞ্চলে জনবসতি গড়ে উঠে নাই।উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিশ্বের মালভূমি গুলোতে বা ইউরোপ ও রাশিয়ায় উত্তরাংশসহ গ্রীনল্যান্ডে মানব বসতি গড়ে উঠে নাই বা বিস্তার লাভ করে নাই।


পক্ষান্তরে নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু (মৌসুমী ও ভূমধ্যসাগরীয় জলবায়ু) অঞ্চল মানব বসতি বিস্তারের জন্য যথেষ্ট উপযোগী বলে ঐ জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চলে মানব বসতির বিস্তার সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়- কারণ এ প্রকৃতির জলবায়ুর প্রভাবে উক্ত অঞ্চলে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়।

৩)মাটি

মাটি মানব বসতি গড়ে ওঠার পশ্চাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কারণ মাটির উর্বর ও অনুর্বর শক্তির উপরে মানব বসতি গড়ে ওঠা অনেকাংশে নির্ভর করে। উর্বর মাটি ফসল উৎপাদনের যথেষ্ট উপযোগী।ফলে উর্বর মৃত্তিকা এলাকায় মানব বসতির ঘনত্ব অনেক বেশি।অপরপক্ষে অনুর্বর বালি মাটি বা পাথুরি মাটি ফসল উৎপাদনের উপযোগী নয় ঐ সব এলাকায় মানব বসতি খুবই কম লক্ষ্য করা যায়। উল্লেখ্য, উর্বর মাটি নদী উপত্যকা বা অববাহিকায় লক্ষ্য করা যায়। আর এ ধরনের মাটি বন্যার ফলে সৃষ্টি হয়।এ কারণে প্রাচীন কাল থেকেই নদী অববাহিকা এলাকায় মানব বসতি গড়ে ওঠার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

৪)পানির সহজলভ্যতা

মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক গুলোর মধ্যে পানির সহজলভ্যতা অতি গুরুত্বপূর্ণ। পানির সহজলভ্যতা বা সরবরাহ ব্যতীত মানব বসতি গড়ে ওঠা সম্ভব নয়।কারণ খাবার পানি থেকে শুরু করে ধোঁয়া-মোছা ও অন্যান্য কাজে দৈনন্দিন প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়।এজন্য বিশ্বের ছোট-বড় সব ধরনের মানব বসতি গড়ে উঠেছে পানির উৎসকে কেন্দ্র করে। আর পানির উৎসগুলো হলো-ঝর্ণা,নদী,খাল-বিল,হাওড়-বাওড়,পুকুর,দিঘী,হ্রদ ইত্যাদি।পানির এ উৎসগুলোর কাছে মানব বসতি বেশি লক্ষ্য করা যায়।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়,পাহাড়ি এলাকায় ঝরনার পানিকে কেন্দ্র করে মানব বসতি গড়ে উঠেছে; উত্তর আমেরিকা, কাশ্মীর ও বাংলাদেশর রাঙ্গামাটিতে হ্রদের পানিকে কেন্দ্র করে মানব বসতি গড়ে উঠেছে। জার্মানীর রাইন নদী, মিশরের নীল নদ, পাকিস্তানের সিন্ধু নদ, যুক্তরাষ্ট্রের মিসিপিসি নদী, ভারতের গঙ্গা নদী, চীনের ইয়াং সিকিয়াং নদী ও বাংলাদেশের পদ্মা,মেঘনা ও যমুনা নদীর পানিকে কেন্দ্র করে অগনিত মানব বসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়াও খাল, বিল ও হাওড়-বাওড়,পুকুর দিঘী ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেও বহু মানব বসতি গড়ে উঠেছে।

খ) সামাজিক বা সাংস্কৃতিক নিয়ামক

১)কৃষি কাজ

বিশ্বের যেসব অঞ্চলে সহজে কৃষি কাজ করা যায় এবং যেসব অঞ্চল বন্যা মুক্ত সেখানে বিক্ষিপ্ত ভাবে মানব বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়।

২)পশুচারণ

অতি প্রাচীন কাল থেকে দেখা যায় পশুচারণ বিক্ষিপ্ত বসতির বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে।পশুচারণ যদি স্থায়ী বা অস্থায়ী হয় তাহলে বসতি বিক্ষিপ্তভাবে গড়ে উঠে। কারণ পশুচারণ থেকে বসতি দূরে হলে যাতায়াতের সময়ের অপচয় হয় বিধায় পশুচারণ ক্ষেত্রের নিকটে এরূপ বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়।

৩)প্রতিরক্ষা

মানব বসতি গড়ে ওঠার জন্য প্রতিরক্ষা অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামক। প্রাচীনকালে দেখা যেত মানুষ বন্য জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একত্রে বসবাস করত। এছাড়া প্রাচীনকালে মানুষ প্রতিরক্ষার সুবিধার জন্যই পুঞ্জিভূত বসতি স্থাপন করে বহিরাগত শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য। এজন্য দেখা যায় যে অঞ্চলে প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা যত বেশি দৃঢ় সে অঞ্চলে জনসংখ্যার ঘনত্ব তত বেশি।

৪)উন্নত পরিবহণ ও যাতায়াত ব্যবস্থা

পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার উপর প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান।যে সমস্ত অঞ্চল হতে স্থল ও জলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও সুলভ হয় সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায়। দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে যাতায়াত ব্যবস্থা অপ্রতুল ও কষ্টসাধ্য,ফলে পার্বত্য অঞ্চল প্রায় মানবহীন। পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা যেখানে যত উন্নত সেখানে মানব বসতির ঘনত্ব তত অধিক। ভগ্ন সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল বন্দর গঠনের জন্য উপযোগী এবং উপকূলবর্তী স্থান থেকে সমুদ্রপথে যাতায়াতের সুবিধা বেশি এ কারণে পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর উপকূলবর্তী অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ।

৫)অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও জীবিকার সুযোগ

খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই সর্বজনীন চাহিদা পূরণ করার প্রাথমিক উপায় হল উপযুক্ত জীবিকার সন্ধান। তাই উপার্জনের সুযোগ যেখানে যত বেশি,জীবন ধারণ করা সেখানে যত সহজ, বাসভূমি হিসাবে সেই স্থান ততো আকাঙ্খিত। সেই কারণে রুক্ষভূমি থেকে শস্য শ্যামল ক্ষেত্রের দিকে,গ্রাম থেকে শহরের দিকে, শহর থেকে সুযোগ সুবিধাপূর্ণ নগরের দিকে মানুষের ঢল নামে।ভৌগোলিক পরিভাষায় একে 'অভিগমন' বা মাইগ্রেশন বলে। বলা বাহুল্য,অতি নিবিড় বসতির উচ্চ জনঘনত্বের অঞ্চলগুলো এভাবেই সম্প্রসারিত হয়েছে।

৬)রাজনীতি

রাজনৈতিক কারনেও দেখা যায় অনেক সময় বসতি গড়ে ওঠে বা পরিবর্তিত হয়।যে সকল স্থানে রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল সেখানে মানুষ স্বাচ্ছন্দে বসতি গড়ে তোলে। অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে অনেক সময় মানব বসতি বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মানুষ অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে বসতি গড়ে তোলে। অর্থাৎ বলা যায় বসতি স্থাপনে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে বিশ্বের যেসব স্থানে বা পরিসরে পরিবেশের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার উপর ভিত্তি করে মানুষ বা কোন জনগোষ্ঠী ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে আবাসিক জীবন যাপন করে থাকে তাকে মানব বসতি বলে। আজকের আর্টিকেলে মানব বসতি কাকে বলে-মানব বসতি গড়ে ওঠার নিয়ামক গুলো সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url