জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক সমূহের বর্ণনা দাও

পৃথিবীর জনসংখ্যা সব দেশে সব অঞ্চলে সমানভাবে বিন্যস্ত নয়।পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক- চতুর্থাংশ লোক দক্ষিণ এশিয়ায় বাস করে।এর প্রধান কারণ হলো এ অঞ্চল সবুজ শ্যামল,উর্বর সমভূমি।যে অঞ্চলে বসবাসের সুবিধা যত বেশি সেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব তত বেশি। জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক সমূহের মধ্যে অন্যতম ভূপ্রকৃতি,জলবায়ু,মৃত্তিকা,পানি সম্পদ, অঞ্চলের অবস্থানিক প্রভাব,অর্থনৈতিক কাজকর্ম, জীবন জীবিকার সুযোগ সুবিধা, উন্নত পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ ইত্যাদি।উপরিউক্ত কারণগুলোর জন্য জনসংখ্যা বন্টনের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।
জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক সমূহের বর্ণনা দাও
ভূপৃষ্ঠে মানুষ কোথায় এবং কিভাবে বসবাস করবে তা নির্ভর করে স্থান এবং স্থানের প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে স্বতন্ত্র প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ নিজেকে খাপ খাইয়ে বসবাস করছে।তবে আশ্রয়,খাদ্য ও পানীয় জলের সহজলভ্যতা এবং আরাম-আয়েস প্রাপ্তির সম্ভাবনা মানুষকে পৃথিবীর মাত্র কয়েকটি অঞ্চল অধিক আকৃষ্ট করে।

জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক

পৃথিবীর জনসংখ্যা সব দেশে সব অঞ্চলে সমানভাবে বিন্যাস্ত নয়। পৃথিবীর কোথাও লোকজন প্রচুর বসবাস করে বলে বাসস্থানের তীব্র অভাব(যেমন:টোকিও,লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, মুম্বাই) আবার কোথাও আদিগন্ত জনহীন, বিস্তীর্ণ প্রান্তর (যেমন: সাহারা,গোবি,গ্রিনল্যান্ড)। ভৌগোলিক পটভূমিতে এই জনবিন্যাসের অসাম্যতা মূলত দুটি কারণে উপর নির্ভরশীল

ক) প্রাকৃতিক কারণ,

খ) আর্থ-সামাজিক কারণ,

ক) প্রাকৃতিক কারণ

১/ভূ-প্রকৃতি

ভূপ্রকৃতি জনসংখ্যা বন্টনের প্রত্যক্ষ নিয়ামক।পার্বত্য বন্ধুর ভূমি,ধসপ্রবণ ঢালুজমি,জলময় জলাভূমি প্রভৃতি নেতিবাচক অঞ্চল বা 'নেগেটিভ এরিয়া' মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত। কিন্তু নদীর বিস্তীর্ণ অববাহিকা,নদীমঞ্চ এর উপর বন্যা থেকে সুরক্ষিত অবস্থান,উপকূলবর্তী সমভূমি,এমনকি শৈলশিরার মধ্যবর্তী সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল উপত্যকা ইত্যাদি জনপদ গড়ে তোলার আদর্শ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। পৃথিবীর আদি সভ্যতা গুলো যেমন: সুমেরীয় সভ্যতা,সিন্ধু সভ্যতা ইত্যাদি নদীমাতৃক।


গঙ্গা,সিন্ধু,ব্রহ্মপুত্র নদীবিধৌত সমভূমি,পদ্মা-মেঘনার সমতল ভূখণ্ড ইত্যাদি কৃষি,শিল্প,পরিসেবার আকর ক্ষেত্র এবং অতি স্বাভাবিক কারণেই এই অঞ্চলগুলো জনাকীর্ণ। সমভূমি অঞ্চলের সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্য পরিবেশের জন্যই সমুদ্রসমতা থেকে মাত্র ২০০ মিটার উচ্চতার মধ্যেই পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ বসবাস করে।সুতরাং জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক হিসেবে অতিগুরুত্বপূর্ণ ভূপ্রকৃতি।

২/জলবায়ু

প্রবল শীত,প্রচন্ড গরম,অবিরাম বৃষ্টি, অনিয়মিত সূর্যালোক ইত্যাদি জনবসতি গড়ে তোলার পক্ষে অসুবিধাজনক। তাই নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্যের উষ্ণ আর্দ্র পরিবেশ বা আলাস্কার হিমশীতল জলবায়ু অঞ্চলে মানুষ একান্ত নিরুপায় না হলে জনপদ গড়ে তোলেননি।বিপরীতভাবে,স্নিগ্ধ জলবায়ু মানুষের কায়িকশ্রম লাঘব করে।মানসিক বিকাশে সাহায্য করে।সংস্কৃতির মান উন্নয়ন করে।সুতরাং যে জলবায়ু মানুষের অর্থনৈতিক কাজকর্মের সহায়ক,সেখানে জনবসতি স্বাভাবিকভাবেই নিবিড়।পৃথিবীর মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চল,ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা প্রভৃতি জলবায়ুমন্ডল নিবিড় জনবসতির অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

৩/মৃত্তিকা

কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের অগ্রগতিতে মাটির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।মৃদু অম্লধর্মী,উর্বর মাটি লাভজনক চাষের পূর্বশর্ত।নদী গঠিত প্লাবন ভূমির পলিমাটি,মধ্য অক্ষাংশের চেরনোজেম কৃষ্ণ মৃত্তিকা ইত্যাদি কৃষি কাজের উপযোগী এবং জনবসতির ঘন সমাবেশের সহায়ক।নীল,হোয়াংহো,ইয়াং সিকিয়াং প্রভৃতি নদ-নদী অববাহিকা ইউক্রেন এর সমভূমি ইত্যাদির কারণে উচ্চ জনঘনত্ব অঞ্চলের উদাহরণ।সুতরাং জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক হিসেবে মৃত্তিকার ভূমিকা অধিক।

৪/পানি সম্পদ

পানি শুধু পানীয় নয়,কৃষি,শিল্প,পরিবহনের উপাদান।তাই বহু ক্ষেত্রেই জনপদ বা জনবসতি জলাশয়কে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে।সরোবর,পুকুর নদী-তীরবর্তী সমতল ক্ষেত্র সেই কারণে জনবসতি গড়ে তোলার পক্ষে আকাঙ্খিত স্থান। কলকাতা,বরাণসী, লন্ডন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি ছোট-বড় শহর বা বাংলার অসংখ্য গ্রাম এভাবে গড়ে উঠেছে।

৫/অঞ্চলের অবস্থানিক প্রভাব

কোন অঞ্চলের অবস্থানগত কারণও জনবসতির ঘনত্বের উপর প্রভাব ফেলে।একটি অঞ্চলের অবস্থান যদি অন্যান্য এলাকা সমূহের সাথে পরিবহন ব্যবস্থা এবং প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা অর্থাৎ সড়ক পরিবহনের মাধ্যমে আন্ত:সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে তাহলে স্থানটি জনসংখ্যাকে আকর্ষণ করে থাকে।এ কারণে মহাদেশগুলোর অভ্যন্তর ভাগ সাধারণত বিরল বসতিপূর্ণ হয় এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল জনবসতির ঘনত্ব বেশি হয়। সমুদ্র উপকূল থেকে মাত্র ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বসবাস করে থাকে।


মহাদেশগুলোর অভ্যন্তরভাগের শুষ্ক ও চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া,অনুর্বর ভূমি,মরু অঞ্চল ও পার্বত্য দুর্গম বৈশিষ্ট্যের তুলনায় সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের সুগম্যতা আর্দ্র ও মনোরম নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু এবং উপকূলীয় অঞ্চল ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সমুদ্রপথ দ্বারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তৃতি ইত্যাদি কারণে জনসংখ্যার উল্লেখিত বন্টন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক হিসেবে অঞ্চলের অবস্থানিক প্রভাব অতিগুরুত্বপূর্ণ।

খ) আর্থ-সামাজিক কারণ

১/অর্থনৈতিক কাজকর্ম ও জীবিকার সুযোগ

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান মানুষের মৌলিক চাহিদা। এই সর্বজনীন চাহিদা পূরণ করার প্রাথমিক উপায় হল উপযুক্ত জীবিকার সন্ধান। তাই উপার্জনের সুযোগ যেখানে যত বেশি,জীবনধারণ করা যেখানে যত সহজ,বাসভূমি হিসাবে সেই স্থান তত আকাঙ্খিত।সেই কারণে রুক্ষভূমি থেকে শস্য-শ্যামল ক্ষেতের দিকে,গ্রাম থেকে শহরের দিকে,শহর থেকে এবং সুযোগ-সুবিধাপূর্ণ নগরের দিকে মানুষের ঢল নামে। ভৌগোলিক পরিভাষায় একে অভিগমন' বা মাইগ্রেশন বলে। বলা বাহুল্য,অতিনিবিড় বসতির উচ্চ জনঘনত্বের অঞ্চলগুলো এভাবেই সম্প্রসারিত হয়েছে।

২/পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা

পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থার উপর প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণ বিদ্যমান।যে সমস্ত অঞ্চল হতে স্থল ও জলপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ ও সুলভ হয় সেখানে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বৃদ্ধি পায়। দূর্গম পার্বত্য অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা অপ্রতুল ও কষ্টসাধ্য,ফলে পার্বত্য অঞ্চল প্রায় মানবহীন।অন্যদিকে ভগ্ন সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল বন্দর গঠনের জন্য উপযোগী এবং উপকূলবর্তী স্থান থেকে সমুদ্রপথে যাতায়াতের সুবিধা বেশি।উল্লেখিত কারণেই পশ্চিম ইউরোপের উন্নতদেশগুলোর উপকূলবর্তী অঞ্চল জনবসতিপূর্ণ।সুতরাং উন্নত পরিবহন ও যাতায়াত ব্যবস্থা জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত।

৩/সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ

জীবিকার সুযোগ ছাড়াও মানুষের সামাজিক চাহিদা পূরণ হওয়া একান্ত প্রয়োজন। সে কারণে শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য,প্রযুক্তির সুযোগ,উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাযুক্ত অঞ্চলগুলোতে পাশাপাশি অন্যান্য অনুন্নত জায়গার তুলনায় জনসংখ্যা চাপ বেশি। গ্রাম থেকে শহরে এই জন্যই জনসংখ্যার বাহুল্য। আবার শহরের মধ্যেও জমির দর সেখানে বেশি। যেখানে সব সুযোগ সুবিধা নাগালের মধ্যে সেখানে জনঘনত্ব স্বাভাবিক কারণেই বেশি।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে কোন দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ,সরকারি ও বেসরকারি নীতির সাফল্য ইত্যাদি কারণগুলো জনসংখ্যা বিন্যাসের সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৪৭ এ ভারত ভাগ ও পাকিস্তান নামে নতুন একটি দেশ তৈরি হওয়ার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাতারাতি উদ্বাস্তু হয়ে যায়। ফলে ভারতীয় উপমহাদেশে জনসংখ্যা বন্টনের সামগ্রিক চিত্র দ্রুত বদলে যায়। একইভাবে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল সৃষ্টি হওয়ার পরে পশ্চিম এশিয়ার জনবন্টনে তারতম্য ঘটে। আবার সাম্প্রতিক ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ, আলজেরিয়া এবং বসনিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদির প্রভাবেও আন্তর্জাতিক অভিগমন জনসংখ্যার বন্টন ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে। আজকের আর্টিকেলে জনসংখ্যা বন্টনের নিয়ামক সমূহের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url