ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ দাও
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
ভৌগোলিক পরিবেশের মূল উপাদান হলো: শিলা মন্ডল, বায়ুমন্ডল, বারিমন্ডল, জীবমন্ডল। এই চারটি মন্ডলীয় পরিবেশের উপর ভিত্তি করে মানুষ তার মেধা ও শ্রম দিয়ে এবং প্রয়োজনের তাগিদে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে তাকে সাংস্কৃতিক বা সামাজিক পরিবেশ বলে। আজকের আর্টিকেলে ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
ভৌগোলিক পরিবেশের সংজ্ঞা
পরিবেশের ইংরেজী প্রতিশব্দ “ Environment" এই শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাধারণ অর্থে আমাদের চারপাশে যে প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট অবস্থা রয়েছে তাকে ভৌগলিক পরিবেশ বলে। একটি জীব মন্ডলের পরিবেষ্টনকারী এবং এতে প্রভাব বিস্তারকারী সজীব ও অজীব উপাদানের সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বা Environment বলে।
এখানে উল্লেখ্য যে, ভৌগোলিক পরিবেশ শব্দটির প্রায় সকল বিষারদগনই ব্যবহার করে থাকেন। এক্ষেত্রে ভূগোলবিদগণ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথিবীর উপাদান তথা মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়েই অনুশীলন করে থাকেন। সেক্ষেত্রে তাদের উল্লেখিত কতিপয় পরিবেশের সংজ্ঞা নিচে দেওয়া হল:
ভৌগোলিক পরিবেশ হল সেই সমস্ত উপাদানের সমষ্টি, যার উৎপত্তি ও সৃষ্টির উপর মানুষের হাত নেই। অধ্যাপক এম.সি আগরওয়ালা
নির্দিষ্ট স্থানে ও সময়ে মানুষের চারিপার্শ্বের অবস্থা সমূহের সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বলে। C.Park (1980)
ভৌগোলিক পরিবেশ হল উদ্ভিদ ও প্রাণি জগতের উপর প্রভাব বিস্তারকারী চারপার্শ্বের অবস্থা গুলোর সমষ্টি-The Oxford Dictionary (1992)
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে জীবমন্ডলের উদ্ভিদ, প্রাণী এবং মানুষের সুস্থ ও স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য যে প্রাকৃতিক ও সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হয় তার সামগ্রিক অবস্থাকে পরিবেশ বা Environment বলে।
ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান
আমরা জানি পরিবেশ মূলত পৃথিবীর ভৌতিক এবং জৈবিক বিষয়গুলোর বিভিন্ন উপাদানের ঘাত-প্রতিঘাতের মিথস্ক্রিয়ার ফলে গঠিত। পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানগুলো কখনই সম্পর্কহীন বা বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। এমন কিছু শক্তি ও প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত কাজ করছে যা এই উপাদানগুলোকে যোগসূত্রে আবদ্ধ করে এক অবিচ্ছেদ্য পরিবেশ সত্ত্বায় পরিণত করছে। যেহেতু পৃথিবীর পরিবেশ জীবন,সম্পদ ও বাস্ততন্ত্রের ধারক এবং বাহক।
সেহেতু পৃথিবীর যে চারটি উপাদান রয়েছে তাই ভৌগোলিক পরিবেশ গঠনের মূল চরিত্র। পরিবেশ গঠনের জন্য কঠিন তরল ও গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা যথাক্রমে অশ্ম মন্ডল (ভূত্বকের অর্ধাংশ) বারিমন্ডল ও বায়ুমন্ডলের সমগোত্রীয় ভৌতিক বা অজীবীয় পরিবেশ গঠন করে। অপরদিকে স্বভোজী (উদ্ভিদ) খাদক (মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণী) এবং বিয়োজক (প্রধান জীবাণু) এই তিনটি অংশ দ্বারা জৈবিক বা জীবীয় পরিবেশ তথা জীব মন্ডলীয় পরিবেশ গঠিত।ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান গুলোকে মোট চারটি ভাগে ভাগ করা যায়।
১/শিলামন্ডলীয় উপাদান,
২/বায়ুমন্ডলীয় উপাদান ,
৩/বারিমন্ডলীয় উপাদান,
৪/জীবমন্ডলীয় উপাদান,
১/শিলামন্ডলীয় উপাদান
ভৌগোলিক পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শিলামন্ডল।শিলা ও খনিজের সমন্বয়ে গঠিত ভূত্বকের কঠিন অংশকে শিলামন্ডল বলে। এটি ৬ টি বৃহৎ প্লেট এবং কতগুলো ক্ষুদ্র প্লেটের সমন্বয়ে গঠিত।প্লেটগুলো সর্বদা সঞ্চরণশীল।কখনো ২টি প্লেট পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে (প্রতিসারী প্লেট বলে) আবার কখনো ২টি প্লেট মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে (অভিসারী প্লেট বলে) আবার কখনো দুটি প্লেট পাশাপাশি অবস্থান করে একে অপরকে অতিক্রম করছে (ট্রান্সফর্ম প্লেট বলে)।
প্লেটের এই ধরনের কাজের ফলে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যমূলক পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে যেমন:প্রতিসারী প্লেটের সীমানায় বৈশিষ্ট্যমূলক ভূমিরূপ ও ভূমিরূপ প্রক্রিয়ায় মধ্য মহাসামুদ্রিক শৈলশিরা,আগ্নেয়গিরি, অগ্নুৎপাত ও ভূমিকম্প ইত্যাদি পরিবেশ সৃষ্টি হয়।অভিসারী প্লেট সীমানায় সমুদ্রখাত,ভঙ্গিল পর্বত, বৃত্তচাপীয় দ্বীপমালা,আগ্নেয়গিরি বলয় এবং বৈশিষ্ট্যমূলক ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়।ট্রান্সফর্ম প্লেট সীমানায় ক্ষুদ্র ভূমিরূপের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়।মহাদেশের ভূমিরূপের মধ্যে পর্বত,মালভূমি,সমভূমি এই তিনটি উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও শিলামন্ডলের উপর নদী, হিমবাহ, বায়ু, সমুদ্র তরঙ্গ, ভৌমজল ইত্যাদি শক্তি, আবহবিকার,সমুদ্র তরঙ্গ,ভর সঞ্চালন,ক্ষয় ও সঞ্চয় এর মাধ্যমে ক্রিয়া করে বৈশিষ্ট্য মূলক ভূমিরূপের সৃষ্টি করে পরিবেশের বৈচিত্র্য আনে। পরিবেশ গঠনে শিলা মন্ডলের আরেকটি বিশেষ উপাদান হচ্ছে মাটি।এই মাটি ভূপৃষ্ঠের উপরে খনিজ ও জৈব পদার্থের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন স্তরযুক্ত প্রাকৃতিক বস্তু।এই মাটিতেই বিশেষ করে কৃষি,বনভূমি, পশু ও মৎস খামার সহ মানুষের বসতি ইত্যাদি পরিবেশ গড়ে উঠেছে।
২/বায়ুমন্ডলীয় উপাদান
ভৌগলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের মধ্যে বায়ুমন্ডল অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।পৃথিবীর প্রাথমিক বায়ুমন্ডলের উদ্ভব হয় পৃথিবীর অভ্যন্তর ভাগ থেকে উৎক্ষিপ্ত হাইড্রোজেনের মাধ্যমে। কালক্রমে অন্যান্য গ্যাস ও তাদের যৌগ আবির্ভূত হয় এবং সম্মিলিতভাবে একটি বিজারনশীল বায়ুমন্ডল উৎপত্তি লাভ করে।এই সময়ে বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন ছিল অনুপস্থিত।উৎপত্তি লাভের পর পৃথিবী যখন শীতল হতে শুরু করে,তখন এর অভ্যন্তরে অবস্থিত বিভিন্ন গ্যাসপুঞ্জ উন্মুক্ত হয়ে একটি গৌণ বায়ুমন্ডলের জন্ম হয়।
এই সময়ে হাইড্রোজেন গ্যাসের ৩টি গুরুত্বপূর্ণ যৌগ মিথেন,পানি এবং অ্যামোনিয়ার উদ্ভব ঘটে। অন্যান্য গ্যাসের মধ্যে ছিল সম্ভবত কার্বন মনোঅক্সাইড, হাইক্লোরিড অ্যাসিড এবং হাইড্রোজেন সালফাইড।কালক্রমে পৃথিবী পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ক্রমশ হ্রাস প্রাপ্ত হলে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পানির সৃষ্টি করে এবং একই সঙ্গে জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে,যা পরবর্তীতে বৃষ্টিরুপে পৃথিবী পৃষ্ঠে নেমে আসে এবং সৃষ্টি হয় বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক পরিবেশ।
আরো পড়ুন: নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর
বায়ুমন্ডলের উর্ধ্বস্তরে পানির উপরে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে হাইড্রোজেন এবং গ্যাসের উৎপত্তি লাভ করে বলে ধারণা করা হয়। সবশেষে একসময় উদ্ভব হয়েছে বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট বর্তমান বায়ুমন্ডল। সুতরাং ভূপৃষ্ঠ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার উপর পর্যন্ত বিস্তৃত যে গ্যাসীয় আবরণ পৃথিবীকে ঘিরে রয়েছে তাকে বায়ুমন্ডলীয় পরিবেশ বলে। বায়ুমন্ডল বিভিন্ন ধরনের গ্যাস,জলীয় বাষ্প, ধূলিকণা ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। এছাড়া মেঘ এবং কুয়াশা বায়ুস্তরের নিম্ন অংশে পৃথিবীব্যাপি ভেসে বেড়ায়। এইগুলো সব পরিবেশের উপাদান।
পরিবেশ গঠনে বায়ুমন্ডলের ভূমিকা
- পৃথিবীতে জীব পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষায় বায়ুমন্ডলের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কারণ বায়ুমন্ডল প্রাণী জগতকে অক্সিজেন এবং উদ্ভিদ জগতকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সরবরাহ করে।
- পরিবেশের নবায়নযোগ্য যে সকল শক্তি প্রয়োজন (যেমন-পানি,বায়ু,সৌরশক্তি) তার উৎস বায়ুমন্ডল।
- বায়ুমন্ডল পরিবেশের গঠনকর এমন একটি উপাদান যা জীব পরিবেশকে সূর্যের অবলোহিত রশ্মি এবং অতিবেগুনি রশ্মির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে।
- বায়ুমন্ডলের উপাদান অক্সিজেন প্রাণীদেহে শক্তি ও উত্তাপ যোগায় এবং দহন কার্যে সহায়তা করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিবেশ থেকে অতিরিক্ত তাপ শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।
- বায়ুমন্ডল প্রাণী পরিবেশের শরীর বৃত্তীয় প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করে।
- বায়ুমন্ডল পানিচক্র, জলীয় বাষ্প,বৃষ্টিপাত,মেঘ তুষারপাত, কুয়াশা সৃষ্টি করে পরিবেশ গঠনে সাহায্য করে থাকে।
- বায়ুমন্ডলের উপাদান ধূলিকণা, তাপ শোষন এবং ঘনীভবনে সাহায্য করে।
- বায়ুমন্ডল ভূপৃষ্ঠের পরিবেশকে মহাশূন্য থেকে আগত উল্কার আঘাত থেকে রক্ষা করে।
- বায়ুমন্ডলের বায়ু শক্তি, মানুষের পরিবেশের শ্রম, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে। এছাড়া বায়ু শক্তির দ্বারা সৃষ্ট বিদ্যুৎ শক্তি, পানি সেচ, শস্যদানা মাড়াই ইত্যাদি অর্থনৈতিক কার্যে সহায়তা করে।
- বায়ুমন্ডল সৌরশক্তির কুপরিবাহী বলে বর্তমান ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ১৫°সেলসিয়াস।
- বায়ুমন্ডল জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এবং ঋতু পরিবর্তন করে পরিবেশের বৈচিত্র্যতা আনয়ন করে।
- মোটকথা বায়ুমন্ডল নিরক্ষীয় উষ্ণতা মেরুবৃত্তীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে যা পরিবেশের মূল নিয়ন্ত্রক।
৩/বারিমন্ডলীয় উপাদান
ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের মধ্যে বারিমন্ডলীয় উপাদান একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে চিহ্নিত।পৃথিবীর উত্তপ্ত তরল অবস্থা থেকে তাপ বিকিরণের মাধ্যমে শীতল ও কঠিন হওয়ার সময়,পৃথিবী পৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের খাত (Basin) ও গর্তের সৃষ্টি হয়। এরপর ঐ সকল অবনমিত অঞ্চলে বায়ুমন্ডলের উপাদান অক্সিজেন এবং হাইড্রোজেন গ্যাস মিলিত হয়ে,পরিবেশিক আকার,আয়তন ও অবস্থান ভেদে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পানির সৃষ্টি হয়েছে।
পৃথিবীপৃষ্ঠের বিভিন্ন অবনমিত অংশে জমাকৃত পানির পরিবেশকে বারিমন্ডল বলে যা সাগর,মহাসাগর, হ্রদ, নদী ইত্যাদি নামে পানির ভাগ দ্বারা গঠিত। বারিমন্ডলের প্রধান উপাদান হল পানি অর্থাৎ হাইড্রোজেন অক্সাইড বা H2O; ২ টি হাইড্রোজেন অনু ও একটি অক্সিজেন অনুর রাসায়নিক যৌগ পানি সৃষ্টি করে। পানিতে দ্রবীভূত লবণের মাত্রা অনুসারে পানি মিষ্টি বা লোনা হয়ে থাকে। পুকুর, নদী, খাল-বিলের পানি মিষ্টি এবং সমুদ্রের পানি লোনা।
কেননা সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত লবণের মাত্রা বেশি। এই লবণ গুলোর মধ্যে সোডিয়াম ক্লোরাইড এর পরিমাণ সর্বাধিক। পরিবেশ গঠনের সঙ্গে বারিমন্ডল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত বারিমন্ডল প্রাকৃতিক পরিবেশের রক্ষণাগার। কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশে পানির যোগান বা সরবরাহ কে অক্ষুন্ন রাখার জন্য পানিচক্র একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পানি ছাড়া জীব বাঁচতে পারে না। উদ্ভিদ ও প্রাণী উভয়ের পানির প্রয়োজন। উদ্ভিদ পানির সাহায্যে সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য প্রস্তুত করে এবং সেই খাদ্যের সাহায্যে সব প্রাণী জীবন ধারণ করে।
এছাড়া শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মৃত্তিকায় পরিণত হয় এবং এই মৃত্তিকা ও পানি এবং বায়ুর সাহায্যে পৃথিবীতে বিভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ তথা বনভূমি ও ফসল বলয় গড়ে উঠছে।হ্রদ-নদী,সমুদ্র ও মহাসমুদ্রের পানি বাষ্পীভূত হয়ে আমাদের জলবায়ু ও আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। অতএব বারিমন্ডল মূলত স্থল, উপকূলীয় সমুদ্রের অগভীর, গভীর এবং শৈবাল পরিবেশ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
৪/জীবমন্ডলীয় উপাদান
পরিবেশের সজীব উপাদান উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সমষ্টিকে জীবমন্ডল বলে।ভৌগলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের মধ্যে জীবমন্ডল অতি গুরুত্বপূর্ণ। এটি জীব ও জীবনের ধারক ও বাহক।মূলত জীবমন্ডল এমন একটি সামগ্রিক পরিবেশ যেখানে পানি,মাটি ও বাতাস আছে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে। তবে জীবমন্ডল যে শুধু সজীব উপাদান উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের যোগফলে গড়ে উঠেছে তা নয় বরং এখানে আছে শক্তির প্রবাহ এবং পানি ,মাটি,বাতাস ইত্যাদি একাধিক জড় উপাদান।
জীবমন্ডলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন সজীব এবং নির্জীব উপাদান গুলোর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এক বৈচিত্র্যময় পরিবেশ। জীবমন্ডলের বিস্তৃতি মাটির গভীরে প্রায় ১০ মিটার, সমুদ্রের গভীরে ২০০ মিটার এবং বায়ুমন্ডলে ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার।জীবমন্ডলের একটি অংশ বনভূমি,অরণ্য, তৃণভূমি,জলাভূমিতে যে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ দেখা যায় এদেরকে সামগ্রিকভাবে উদ্ভিদ সংস্থান বা স্বাভাবিক উদ্ভিদ পরিবেশ বলে।
আবার একক বিশিষ্ট পরিবেশ প্রাণী ও জীবাণু সমন্বিতভাবে পরস্পর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিশেষ উদ্ভিদ প্রজাতি গড়ে উঠে একে উদ্ভিদ সম্প্রদায় বলে। এদের সঙ্গে পরিবেশের এক অভিযোজন সম্পর্ক রয়েছে। এই সমস্ত উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে যথেষ্ট মিল থাকায় এরা প্রতিযোগিতা করে বেঁচে থাকতে সমর্থ হয়। এইভাবে পৃথিবীর এক এক অংশে এক এক উদ্ভিদ সম্প্রদায়ের পরিবেশ গড়ে উঠে ও পরিবেশের বিভিন্নতা সৃষ্টি করে।
পরিবেশ গঠনে জীবমন্ডলের ভূমিকা
- পৃথিবীর শিলামন্ডলের উপরিভাগ,বায়ুমন্ডলের নিম্নাংশ এবং বারিমন্ডল মিলিত হয়ে একটি পরিবর্তনশীল পরিবেশ গঠন করে, এই পরিবর্তনশীল অঞ্চলই হচ্ছে জীব পরিবেশ বা জীবমন্ডলীয় পরিবেশ। এটি উদ্ভিদ ও প্রাণী স্থানীয় এবং এর সম্পৃক্ত বিভিন্ন পরিবেশ গঠন করে।
- জীবমন্ডলের বিভিন্ন প্রাণী বা জীবগোষ্ঠী বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিবাস বা বাসভূমি গড়ে তুলে প্রত্যেকটি নিবাস একটি জীবগোষ্ঠীর জন্য এক একটি ভিন্ন পরিবেশ গঠন করে থাকে। যেমন স্থল ভাগে মানুষের বাসভূমি একটি পরিবেশ,নদীর মোহনায় লবণ ও মিষ্টি পানির মিশ্র পরিবেশ ইলিশ,স্যামন ইত্যাদি মাছের বাসভূমি; উষ্ণ স্বল্প বৃষ্টির মরুভূমি পরিবেশ, কাটা ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ এবং উট, ঘোড়া ইত্যাদি প্রাণীর বাসভূমি; সমুদ্রের লবণাক্ত পরিবেশে তিমি মাছের বাসভূমি ইত্যাদি।
- জীবমন্ডলের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগৎ মাটি ও জলবায়ুর সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতান্ত্রিক একক পরিবেশ গড়ে উঠে তাকে বায়োম বলে।
- জীবমন্ডলের সকল প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদকূল,যাদের মধ্যে রয়েছে সকল প্রকার উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, জীবাণু, পতঙ্গ, পাখি,সরীসৃপ ও স্তন্যপায়ী প্রাণী।এগুলো নিয়ে যে বৈচিত্র্যপূর্ণ জীব পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তাকে জীব বৈচিত্র্য বলে।এগুলো স্ব স্ব পরিবেশে বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে অভিযোজনে উৎপন্ন লালিত পালিত ও বিকশিত হয়।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি পরিবেশ একক কোন বিষয় নয়, তাই সে একক ভাবে গঠিতও হয়নি। ইহা অশ্ব মন্ডলের খনিজ, শিলা, মাটি, পানি এবং বায়ুর উপাদান দ্বারা স্থলজ পরিবেশ, বারিমন্ডল শুধুমাত্র পানির উপাদান দ্বারা পানির যাবতীয় পরিবেশ, বায়ুমন্ডল তার বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা বায়ুবীয় পরিবেশ এবং এই তিনটিকে কেন্দ্র করে বা নির্ভর করে গড়ে উঠেছে জীবমন্ডলীয় বা জীব পরিবেশ।এই চারটি উপাদান কে কেন্দ্র করে সমন্বিতভাবে সৃষ্টি হয়েছে সামগ্রিক ভৌগোলিক প্রাকৃতিক পরিবেশ। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশকে কেন্দ্র করে মানুষ তৈরি করেছে মানুষ সৃষ্ট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অপ্রাকৃতিক পরিবেশ। মোটকথা উপরোক্ত চারটি ভাগ সমগ্র ভৌগোলিক পরিবেশকে সার্বিকভাবে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাবণ্যে এবং বৈচিত্র্যময় একটি পরিবেশ গঠনে সাহায্য করছে। আজকের আর্টিকেলে ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।