ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ লিখ
প্রিয় পাঠক আপনারা কি ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
অন্ধকার যুগ (The Dark Age) নামে অভিহিত করা হয়। কারণ এই সময় দীর্ঘদিন যাবৎ মানুষের জ্ঞান ভান্ডারে কোন নতুন ভৌগোলিক তথ্যের সংযোজন হয়নি। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে অনুসন্ধানের উদ্দীপনা মানুষের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনৈতিক অস্থিরতা,অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অবক্ষয় এ সময় অন্ধকার যুগ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।আজকের আর্টিকেলে ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।
অন্ধকার যুগ
দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে রোমান সাম্রাজ্যে নেমে আসে রাজনৈতিক অস্থিরতা,অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অবক্ষয়।এই নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের দীর্ঘদিনের শত্রু জার্মানী রোমান সাম্রাজ্য আক্রমণ করে এবং জার্মানদের হাতে রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। এই সময় জার্মানদের নিষ্টুরতা ও নৈরাজ্যের কবলে নিষ্প্রভ হয়ে যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা বনিয়াদী যুগ। বনিয়াদী রোমান যুগের অবসানের পরবর্তী ৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরব ভূমিতে ৬০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এবং ইউরোপে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় যে স্থবিরতা,পশ্চাদপদতা ও কুসংস্কার নেমে আসে ভৌগোলিক ইতিহাসে এই সময়কালকে অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা হয়।
রোমানদের আধিপত্য অবসানের সাথে সাথে বনিয়াদী যুগের ভৌগোলিক জ্ঞান ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। কারণ এই সময় দীর্ঘদিন যাবৎ মানুষের জ্ঞান ভান্ডারে কোন নতুন ভৌগোলিক তথ্যের সংযোজন হয়নি।বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে ক্রমে এমন একটি সময়ের আবির্ভাব হয় যখন উল্লেখিত সময়কালে মানুষের অনুসন্ধানের আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত হয়ে আসে। প্রকৃতপক্ষে এই সময়ে অনুসন্ধানের উদ্দীপনা স্তব্ধ হয়ে যায়। ভৌগলিক জ্ঞান বিকাশের ইতিহাসে এই অবসাদগ্রস্ত সময়কালকে অন্ধকার যুগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।এই সময়ের উল্লেখযোগ্য ভূগোলবিদদের মধ্যে ম্যাক্রোরিয়াস,কসমস, ওরোসিয়াস,ইসিডরের নাম উল্লেখযোগ্য।
ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ
অন্ধকার যুগ যে সকল কারণে সংঘটিত হয় সে সকল কারণগুলোকে নিম্নরূপ বিন্যাস করা যায়।যেমন:
১/রাজনৈতিক কারণ,
২/অর্থনৈতিক কারণ,
৩/সামাজিক কারণ,
৪/ধর্মীয় কারণ,
১/রাজনৈতিক কারণ
গ্রীক অধিশ্বর মহাবীর আলেকজান্ডার দি গ্রেট তদানীন্তন জ্ঞাত পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন।তার রাজ্যের সীমা পূর্বে সিন্ধু নদের তীর থেকে পশ্চিমে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই বিশাল ও প্রকাণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে মহাবীর আলেকজান্ডার দি গ্রেট উপাধিতে ভূষিত হন। মহাবীর আলেকজান্ডারের শাসনামলকে গ্রিক সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
আরো পড়ুন: ভৌগোলিক পরিবেশের উপাদান সমূহের বিবরণ দাও
প্রাচ্যদেশ বিজয় করে ফেরার সময় পথে প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে পারস্যে শ্বশুরালয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করেন।আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর রোম সাম্রাজ্যের দ্বন্দ্ব শুরু হয়।কে রাজা হবেন এ বিষয় নিয়ে কলহের সূত্রপাত হয়। সম্পূর্ণ রোম সাম্রাজ্যকে চারটি অঞ্চলে বিভক্ত করে আলেকজান্ডারের চার প্রধান সেনাপতি এক একটি অংশের শাসনকর্তা হিসেবে নিয়োজিত হন। পশ্চিম অংশের শাসনকর্তা নিয়োজিত হন জুলিয়াস সিজার।
ক)জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণ
জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের পরিকল্পনাই ছিল অন্ধকার যুগ নেমে আসার একমাত্র কারণ। মহাবীর আলেকজান্ডার একটি সুসংঘবদ্ধ ও বিশাল সেনাবাহিনী রেখে যান যা পরবর্তীকালে জুলিয়াস সিজারকে রাজ্য জয়ে প্ররোচিত করে। জুলিয়াস সিজার এই প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মিশর জয়ের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হন।কিন্তু মিশর অবিশ্বরী মহারাণী ক্লিওপেট্রার রূপের বানে বৃদ্ধ হয়ে মিশর বিজয়ের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করেন এবং ক্লিওপেট্রার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েন।এই ঘটনায় রোমান সাম্রাজ্যে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা দেয়।
খ)জার্মানীদের সাথে বিরোধ
জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পরে রোমান সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলার অভাব দেখা দেয়। এ সুযোগে জার্মানের সেনাবাহিনী রোমান আক্রমণ করে ও রোমান সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে হত্যাযজ্ঞ চালায়।জার্মানের সেনাবাহিনী লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করে রোমান কীর্তি গ্রীক স্থাপত্যগুলো ধ্বংস করে দেয়। পন্ডিতবর্গদের হত্যা করে এবং আলেকজান্দ্রিয়ার মূল লাইব্রেরী ভবনে অগ্নিসংযোগ করে ভস্মিভূত করে দেয়।এর ফলে ধীরে ধীরে জ্ঞানের প্রদীপ নিষ্প্রভ হয়ে আসে। সমগ্র পৃথিবী ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।
২/অর্থনৈতিক কারণ
রোমান যুগের প্রথম দিকে রোমানদের সাথে ভারত, পারস্য,আরব ও আফ্রিকার পূর্ব উপকূলীয় রাজ্যগুলোর সাথে বাণিজ্য বিনিময় ও জ্ঞানের আদান-প্রদান ছিল। কিন্তু কালক্রমে এসব অঞ্চলে রোমানদের বাণিজ্য হ্রাস পায়। ফলে রোমান অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। দূর্বল অর্থনীতির প্রভাবে আক্রান্ত হয় রোমান সেনাবাহিনীর সদস্যরাও। সৈন্য বাহিনীর বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। ফলে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয় যা জার্মানদের যুদ্ধাভিলাশে উৎসাহিত করে তোলে।
৩/সামাজিক কারণ
জুলিয়াস সিজারের অকাল মৃত্যুর কারণে রোমান সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অস্থিরতা নেমে আসে। রোমান সমাজে মানুষেরা সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক অবস্থায় নেমে আসে। সমাজে রাহাজানি ও লুটপাট বৃদ্ধি পায়। মানুষ অলস এবং কর্মবিমুখ হয়ে ওঠে।সামাজিক বিশৃংখলা বৃদ্ধি পায়। রোম সাম্রাজ্যে বহির্বিশ্ব বাণিজ্যে ভাটা পড়ার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা শিথিল হয়ে পড়ে।কর্মহীন বেকারত্ব সমগ্র রোম সাম্রাজ্যেকে গ্রাস করে ফেলে।এসব কারণে শক্তিশালী রোম সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
৪/ধর্মীয় কারণ
ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ সমূহের মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব ও গোঁড়ামি একটি অন্যতম প্রধান কারণ। খ্রিস্টান ধর্ম প্রবর্তনের পর বাইবেল ও বিজ্ঞানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। বাইবেলে বর্ণিত আছে পৃথিবী স্থির। অন্যদিকে বিজ্ঞান বলে পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ভ্রাম্যমান। এরূপ নানা বিষয়ে গীর্জার সাথে জ্ঞানীদের নানা মত পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সমগ্র রোমান জাতি দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।এ পরিস্থিতিতে জ্ঞানচর্চায় স্থবিরতা নেমে আসে যা পরবর্তী পর্যায়ে অন্ধকার যুগের সূচনা করে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষভাগে রোমান সাম্রাজ্যের নেমে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতা,অর্থনৈতিক মন্দা,ধর্মীয় ও সামাজিক অবক্ষয়। বনিয়াদী রোমান যুগের অবসানের পরবর্তী ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আরব ভূমিতে ৬০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এবং ইউরোপে ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যে স্থবিরতা, পশ্চাদপদতা ও কুসংস্কার নেমে আসে ভৌগোলিক ইতিহাসে এই সময়কালকে অন্ধকার যুগ নামে অভিহিত করা হয়। আজকের আর্টিকেলে ভূগোলে অন্ধকার যুগ সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।