নিয়ত বায়ু প্রবাহ আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি নিয়ত বায়ু প্রবাহ সম্পর্কে জানতে চান। তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে নিয়ত বায়ু প্রবাহ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।
নিয়ত বায়ু প্রবাহ আলোচনা কর
নিয়ত বায়ু প্রবাহ অর্থ নিয়মিত প্রবাহমান বায়ু। যে সব বায়ু নিয়মিতভাবে সারা বছর উচ্চচাপ বলয় থেকে নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয় সেগুলি নিয়ত বায়ু হিসেবে পরিচিত। এই আর্টিকেলে নিয়ত বায়ুপ্রবাহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

নিয়ত বায়ু প্রবাহ

নিয়ত বায়ু প্রবাহের আরেক নাম স্থায়ী বায়ু প্রবাহ অথবা প্রবাহমান বায়ু। নিয়ত বায়ু প্রবাহ সারা বছর নিয়মিত ভাবে উচ্চচাপ বলয় থেকে নিম্নচাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে।এপ্রেক্ষিতে চাপ বলয়ের সাথে নিয়ত বায়ু প্রবাহের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। নিয়ত বায়ু প্রবাহ মূলত তিন প্রকার:

ক) আয়ন বায়ু বা বানিজ্য বায়ু
খ) প্রত্যায়ন বায়ু বা পশ্চিমা বায়ু
গ) মেরুদেশীয় বায়ু

ক) আয়ন বায়ু বা বানিজ্য বায়ু

উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে (৩০°-৩৫°উ.ও দ. অক্ষাংশ) নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে প্রবাহমান বায়ু আয়ন বায়ু বা বানিজ্য বায়ু নামে পরিচিত। জার্মান শব্দ trade এর অর্থ track বা পথ। blow trade শব্দের অর্থ অবিরত ভাবে একই দিকে স্থায়ীভাবে প্রবাহিত হওয়া। ইংরেজি শব্দ trade এর অর্থ বাণিজ্য যা অনেকে এটার ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকেন। তারা পুরাকালে বাণিজ্যিক পালতোলা জাহাজ এর গতিপথ অনুসরণ করত বিধায় এর নামকরণ বাণিজ্য বায়ু করেছে।

আয়ন বায়ুর বৈশিষ্ট্য

  • আয়ন বায়ু উত্তর গোলার্ধে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়। কোরিওলিস শক্তির কারণে এই বায়ুদ্বয় (উত্তর ও দক্ষিণ আয়ন বায়ু) উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে যায় ফেরেলের সূত্রানুসারে। উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু নামে পরিচিত।
  • আয়ন বায়ু ৩০° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ হতে নিরক্ষীয় নিম্ন চাপ বলয়ের দিকে প্রবাহিত হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে এর তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
  • মহাদেশীয় ভূ-ভাগ অতিক্রম করায় আয়ন বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে সাধারণত বৃষ্টিপাত হয় না। মহাদেশের পূর্বাংশে কিছুটা সমুদ্রভাগ অতিক্রম করে আসায় আয়ন বায়ু জলীয়বাষ্প সমৃদ্ধ হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটালেও পশ্চিমাংশে কোন বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না। এজন্য আয়ন বায়ু প্রবাহিত মহাদেশের পশ্চিমাংশ বৃষ্টিহীন এবং ক্রান্তীয় মরুভূমি সমূহ এই বায়ু প্রবাহের গতিপথে সৃষ্টি হয়েছে।
  • নিরক্ষীয় অঞ্চলে গমন করলে আয়ন বায়ু জলভাগ থেকে আদ্রর্তা গ্রহণ করে সিক্ত হয় এবং অস্থিতিশীল হয়ে উর্ধ্বগামী হয়। এক্ষেত্রে আয়ন বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটায়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু এবং দক্ষিণ পূর্ব আয়ন বায়ু পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং যে রেখা বরাবর এ সংঘর্ষ ঘটে তা আন্ত:ক্রান্তীয় অভিসরন হিসাবে আখ্যায়িত।
  • আয়ন বায়ু ঘন্টায় ১৫-২৫ কিলোমিটার বেগে প্রবাহিত হয় এবং সারাবছর এর গতিপথ নির্দিষ্ট থাকে।
  • আয়ন বায়ু যখন সমুদ্রভাগ অতিক্রম করে তখন এর গতিবেগ অনেক বেড়ে যায়।
  • ভারত মহাসাগর আয়ন বায়ু পরিবর্তিত হয়ে গ্রীষ্মকালে মৌসুমী বায়ুতে পরিণত হয়। অন্যভাবে বলা যায় গ্রীষ্মকালে ভারত মহাসাগরে মৌসুমী বায়ু আয়ন বায়ুর স্থান দখল করে।

খ) প্রত্যায়ন বায়ু বা পশ্চিমা বায়ু

প্রত্যায়ন বায়ু বা পশ্চিমা বায়ু উপক্রান্তীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে উপমেরুর নিম্নচাপ বলয়ের দিকে সারাবছর নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হয়ে থাকে। অর্থাৎ এর স্থায়িত্ব হল ৩০°- ৩৫° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ থেকে ৬০°- ৬৫° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে থাকে। এর প্রবাহদিক আয়ন বায়ুর বিপরীত হওয়াতে একে প্রত্যায়ন বায়ু কিংবা পশ্চিমা বায়ু বলা হয়ে থাকে।

প্রত্যায়ন বায়ু বা পশ্চিমা বায়ুর বৈশিষ্ট্য

  • প্রত্যায়ন বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণ দিক থেকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হয়।
  • কোরিওলিস শক্তি এভাবে দিকভ্রষ্ঠ হয়ে প্রত্যায়ন বায়ু উত্তর গোলার্ধে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। উভয় গোলার্ধে পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় বলে এই বায়ু প্রবাহ পশ্চিমা বায়ু প্রবাহ নামে পরিচিত।
  • প্রত্যায়ন বা পশ্চিমা বায়ু উষ্ণ অক্ষাংশ থেকে শীতল অক্ষাংশের দিকে গমন করাতে এবং প্রবাহ পথে জলভাগ থাকায় নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে এই বায়ু ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে। মহাদেশের পশ্চিম প্রান্তে বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ,পশ্চিম কানাডা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম চিলিতে প্রত্যয়ন বায়ুর প্রভাবে ব্যাপক বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে।
  • নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলে ঘূর্নিবাত্যা ও প্রতীপ ঘূর্নিবাত্যা কারণে প্রত্যয়ন বায়ুর গতিপথ অনেক সময় বাধাগ্রস্ত কিংবা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
  • উত্তর গোলার্ধে বিপুল স্থলভাগ ও পাহাড় পর্বত থাকাতে প্রত্যায়ন বায়ুর প্রবাহ বিঘ্নিত হয়ে থাকে।
  • দক্ষিণ গোলার্ধে সামান্য স্থলভাগ এবং বিপুল জলরাশি থাকাতে প্রত্যায়ন বায়ু বাধাহীনভাবে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়। ৪০°-৬০°দক্ষিণ অক্ষাংশের মধ্যে এই বায়ুপ্রবাহ অত্যন্ত শক্তিশালী থাকে। এজন্য ঐ অংশে পশ্চিমা বায়ু প্রবাহকে (Brave West Wind)'বা সাহসী পশ্চিমা বায়ু বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন অক্ষাংশে প্রত্যায়ন বায়ুর পরিচিত নিম্নরূপ:
-৪০°দক্ষিণ অক্ষাংশে গর্জনশীল চল্লিশা ( Roaring Forties)
-৫০°দক্ষিণ অক্ষাংশে ভয়ংকর পঞ্চাশ (Furious Fifties)
-৬০°দক্ষিণ অক্ষাংশে তীব্র চিৎকারকারী ষাট ( Shrieking Sixties)

গ)মেরুদেশীয় বায়ু

মেরুদেশীয় উচ্চচাপ বলয় থেকে উপমেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত সাংবাৎসরিক বায়ু মেরুদেশীয় বায়ু হিসেবে পরিচিত। এটি উত্তর গোলার্ধে সুমেরু বায়ু (Arctic wind)এবং দক্ষিণ গোলার্ধে কুমেরু বায়ু (Antarctic wind) নামে পরিচিত।

মেরুদেশীয় বায়ুর বৈশিষ্ট্য

  • উত্তর গোলার্ধে এই বায়ু উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব থেকে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।
  • মেরু এলাকা থেকে আগত বিধায় বায়ু শুষ্ক ও শীতল।
  • মেরু দেশীয় বায়ুর প্রভাবে দক্ষিণ গোলার্ধে প্রবল ঝড় ও বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয়।
  • ক্রান্তীয় এলাকার নিকট থেকে আগত পশ্চিমা বায়ুর সঙ্গে মেরু বায়ুর সংযোগ ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি করে।
  • এ বায়ু প্রবাহ মেরু বৃত্তের নিম্নচাপ বলয়কে নিম্ন অক্ষাংশের দিকে ঠেলে দেয়।
  • বরফ-শীতল বায়ুপ্রবাহের কারণে প্রবল শৈত্য আনিত হয় এবং মাঝে-মধ্যে তুষার ঝড়ের সৃষ্টি হয়ে থাকে।
  • এ বায়ুর গতিবেগ ঘন্টায় ২ কিলোমিটারের কাছাকাছি।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে নিয়ত বায়ু প্রবাহ মূলত স্থায়ী বায়ু প্রবাহ। তবে নিয়ত বায়ু প্রবাহ সারাবছর চালু থাকলেও কিছু ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। জানুয়ারি ও জুলাই মাসে উপক্রান্তীয় অঞ্চলে উচ্চচাপ জনিত প্রবল বায়ুপ্রবাহ সৃষ্টি হলেও অনুরূপ শক্তিসম্পন্ন নিম্নচাপ জনিত বায়ুপ্রবাহ দেখা যায় না। আজকের আর্টিকেলে নিয়ত বায়ু প্রবাহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url