ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান আলোচনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান সম্পর্কে জানতে চান।তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য।কারণ আজকের আর্টিকেলে ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান আলোচনা কর
আল-বিরুনীর লিখিত ছোট বড় ১১৪ টি পুস্তক-পুস্তি কার সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়েছে।এগুলো হচ্ছে যুক্তিতর্ক জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কিত ১৮ টি,স্থানের অবস্থান,দূরত্ব, শহর-নগরের আয়তন সম্বন্ধীয় ১৫ টি, সাধারণ গণনা সম্পর্কীয় ৮টি,আলো ও গতি সম্পর্কীয় ৪ টি,যন্ত্রাদি ও সেগুলোর ব্যবহার সম্পর্কীয় ৫ টি, কাল ও সময় সম্পর্কীয় ৫ টি,উল্কা ও কুজঝটিকা সম্পর্কীয় ৫ টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কীয় ৭ টি।গ্রন্থগুলো থেকে তার প্রখর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। আজকের আর্টিকেলটি পড়লে ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। তাই সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ার অনুরোধ রইলো।

আল-বিরুনী

আল-বিরুনীর পুরো নাম আবু রায়হান মোহাম্মদ আল বিরুনী যিনি পৃথিবীর সর্বকালের বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে উজবেকিস্তান এর বিখ্যাত শহর খোয়ারিজম এর উপকণ্ঠে জন্মগ্রহণ করেন।জ্ঞান সাধনার প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ভূগোল এবংএর বিভিন্ন বিষয়ের উপর আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন।

প্রকৃতপক্ষে পদার্থ বিজ্ঞান,গণিতশাস্ত্র,দর্শন,জ্যোতির্বিদ্যা, ইতিহাস ও খনিজ বিদ্যা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য।তার অধিকাংশ বিখ্যাত গ্রন্থে কোন না কোনভাবে ভৌগোলিক ধারণা গুরুত্ব পেয়েছিল।তার রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে,


'কিতাব আল হিন্দ'এবং 'আল-কানুন আল মাসুদী'এ ভৌগোলিক জ্ঞানের অভিব্যক্তি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি ভূগোলকে শুধু বর্ণনামূলক হিসাবে না দেখে পরিমাপমূলক হিসাবে দেখতেও আগ্রহী ছিলেন। নিচের বিভিন্ন বিষয়ের উপর আল-বিরুনীর ভৌগোলিক অবদান আলোচনা করা হলো:

ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান

১/বাসযোগ্য পৃথিবী সম্পর্কে ধারনা

মানুষের বাসপোযোগী পৃথিবীর সম্বন্ধে তার পূর্ববর্তীদের চেয়ে তিনি ভালো ধারণা দিতে পেরেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, আফ্রিকা মহাদেশ দক্ষিণ দিকে বেশি বিস্তৃত এবং দক্ষিণের মহাসাগর নৈা- চলাচলের উপযোগী।আল-বিরুনী ভূকেন্দ্রিক তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন এবং গোলাকার পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘুরছে বলে মনে করতেন।

তাছাড়া সূর্যগ্রহণ সম্পর্কেও তিনি ধারণা প্রদান করেন। আল-বিরুনী সর্বপ্রথম দক্ষিণ মেরুর অস্তিত্ব এবং উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে ঋতু পার্থক্য সম্বন্ধে সভ্য জগতকে অবহিত করাতে সমর্থন হয়েছিলেন।অর্থাৎ ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান অপরিসীম।

২/প্রাকৃতিক ভূগোলে অবদান

'কিতাবুল হিন্দ'নামক গ্রন্থে তিনি প্রাকৃতিক ভূগোলের বিভিন্ন শাখায় তার অবদান তুলে ধরেছেন।বিশেষ করে ভারতীয় সমভূমির উদ্ভব সম্পর্কিত তার মতামত এবং সেখানকার ভূতত্ত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। উল্লেখিত গ্রন্থে তিনি হিমালয়ের দক্ষিণে ভারতের বিস্তৃত সমভূমির কথা উল্লেখ করেছেন যার সম্ভাব্য উৎপত্তি সম্পর্কে আল-বিরুনীর ধারনা ছিল খুবই বিজ্ঞানসম্মত।


তিনি বলেন,এটি ভারতের একটি অন্যতম সমভূমি,যা দক্ষিণে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এর তিন দিকে উচ্চ পর্বত শ্রেণী বর্তমান, যেখান থেকে পানিরাশি নির্গমন হয়ে থাকে। তার মতে,অঞ্চলটি অতীতে সমুদ্রে গর্ভে নিমজ্জিত ছিল যা ক্রমাগত নদীবাহিত পলল সঞ্চিত হয়ে উক্ত সমভূমি গঠিত হয়েছিল।

আল-বিরুনী জলবায়ু ও ঋতু পরিবর্তন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছেন। তিনি সৌর পরিক্রমণের সাথে সাথে ঋতু পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি ভারতের বৃষ্টিপাতের উদ্ভূত আচরণ দেখে মৌসুমী বৃষ্টিপাতের বৈশিষ্ট্যসূচক বর্ণনা দিয়েছেন।এছাড়াও তিনি বিভিন্ন নদীর গতিপথ ও উৎস সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

৩/জ্যোতির্বিদ্যায় অবদান

আল-বিরুনী জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।তার 'কিতাবুল হিন্দ'গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যার বিভিন্ন বিষয় যেমন,পৃথিবী ও আকাশের গঠন,গ্রহের আকার,দূরত্ব ও ক্রোম,গ্রহগুলোর অবস্থান,রাশিচক্র, ধ্রুব,নক্ষত্র ইত্যাদি সম্পর্কে জ্যোতির্বিদদের ধারণা তুলে ধরেন।তিনি আকাশের সপ্তর্ষীমন্ডল,গ্রহগুলোর অবস্থান, গ্রহের আকার, দূরত্ব ও ক্রম,চন্দ্রের রাশিচক্র ও ক্রান্তিবৃত্ত, নক্ষত্রের উদয় অস্ত নিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক আলোচনা করেছেন।

তিনি ছায়াপথ সম্পর্কে এ্যারিষ্টোটলের ধারণাকে খন্ডন করে বলেন, ছায়াপথ হচ্ছে নক্ষত্রের সর্বোচ্চ বিস্তৃতি অর্থাৎ ছায়াপথের একটি অংশ হচ্ছে নক্ষত্র।এছাড়াও তিনি চন্দ্রকলার হ্রাস বৃদ্ধি সম্পর্কে ধারনা প্রদান করেন।অর্থাৎ ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান অপরিসীম।

৪/জোয়ার ভাটা সম্বন্ধে ধারণা

আল-বিরুনী জোয়ার ভাটার বৈচিত্র সম্পর্কেও তার ধারণা প্রকাশ করেন।তিনি চন্দ্রকলার সাথে জোয়ার ভাটার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন চন্দ্রকলার সাথে জোয়ারের পানি কিরূপে বৃদ্ধি পায় এবং ভাঁটার সময় তা হ্রাস পায় তার ব্যাখ্যা দেন।তার মতে,মধ্যরাতে চন্দ্র মধ্যরেখার উপনীত হলে ভাঁটা শুরু হয়। তিনি জোয়ার ভাটার সময়ের পরিবর্তনের বিষয়টিও হিসাব করতেন।

৫/গাণিতিক ভূগোলে অবদান

আল-বিরুনী 'আল কানুন,আল মাসুদী'নামক গ্রন্থে ভূপৃষ্ঠের বক্রতার পরিমাণ গাণিতিক প্রক্রিয়ায় পরিমাপ করে গাণিতিক ভূগোলের কলেবর বৃদ্ধি করেন এবং বহু স্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ নির্ণয় করেন। তিনি স্টেরিওগ্রাফিক অভিক্ষেপের সহজ পদ্ধতি প্রবর্তন করে পৃথিবীর মানচিত্র অংকন পদ্ধতির বিকাশ সাধন করেন।

আরো পড়ুন:

এছাড়াও তিনি সমুদ্রের অবস্থান বর্ণনা করার জন্য একটি গোলাকার মানচিত্র অঙ্কন করেন। তার গ্রন্থে দিবারাত্রির সংজ্ঞা প্রদান করে বছর,ঋতু,দিন ও সময়ের বিভিন্ন পরিমাপের ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান অপরিসীম।

৬/অর্থনৈতিক ভূগোলে অবদান

অর্থনৈতিক ভূগোলের মূল চালিকাশক্তি যোগাযোগ ও ভ্রমণপথ,উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য।আল-বিরুনীর সময়কালে তিনি উল্লেখিত বিষয়গুলোতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিভিন্ন ভ্রমণকারী, সৈন্যবাহিনী ও তীর্থ যাত্রার প্রয়োজনে ভূমির বন্ধুরতা,জলবায়ু ও উদ্ভিজ্জের উপর ভিত্তি করে বড় বড় পথ চিহ্নিত ও সেগুলোর ব্যাপক ব্যবহার করত।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পূর্ববর্তী ব্যবহৃত পথগুলো ছাড়াও অনেক নতুন নতুন ভ্রমণপথের সৃষ্টি হয়।যেগুলো বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ী বণিক,ভ্রমণকারী ও তীর্থ যাত্রীরা ব্যবহার করত এবং তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভৌগোলিক উপাত্ত পাওয়া যেত। আল-বিরুনী ভারতের অসংখ্য শহর,নগর ও শিক্ষাক্ষেত্রের খ্যাতির কথা উল্লেখ করেছেন।

যার ফলে যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে।সে সময় সোমনাথকে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির বর্হিদ্বার হিসাবে পূর্ব আফ্রিকার বা পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ ও চীন থেকে আগতদের দ্বার হিসাবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান অপরিসীম।

৭/আঞ্চলিক ভূগোলে অবদান

আঞ্চলিক ভূগোলের বিকাশে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। তিনি আফ্রিকা মহাদেশ দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হিসাবে বিবেচনা করেছেন। এশিয়া ও ইউরোপের ভূগোল বর্ণনা করার সময় আল-বিরুনী হিমালয় থেকে আল্পস পর্যন্ত প্রায় অবিরত পর্বত শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেছেন।

তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা,মোজাম্বিক ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদ অঞ্চলের লোক বসতির কথা উল্লেখ করেছেন। তার মতে, এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশ দ্বয়ের উত্তরে বরফ সাগর রয়েছে বলে তিনি ধারণা ব্যক্ত করেন। সুতরাং ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান অনবদ্য।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে,আল-বিরুনী তার রচিত 'কিতাবুল হিন্দ 'নামক গ্রন্থটিতে ভারতীয় বিজ্ঞান, দর্শন,সাহিত্য ও ধর্মের বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। এছাড়াও তিনি ভারতের হিন্দু ও মুসলমানদের আচার ব্যবহার,আচরণ,ধর্মীয় রীতিনীতি,হিন্দুদের ব্যাভিচার ও মুসলমানদের সুষ্ঠু বৈবাহিক নিয়ম-কানুনসহ আরবদের কুপ্রথার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করেছেন।এই গ্রন্থে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞান, গ্রহ, রাশিচক্র, ধ্রুব নক্ষত্র, পৃথিবী ও আকাশ সম্বন্ধে ভারতীয়দের ধারণা, গ্রহের আকার, দূরত্ব, রাশিচক্র ও নক্ষত্রের উদয় অস্ত প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুতরাং ভূগোলে মুসলিম পন্ডিত আল-বিরুনীর অবদান ছিল অনবদ্য।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url