মৌসুমী বায়ু কাকে বলে-মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহের বর্ণনা দাও
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন মৌসুমী বায়ু কাকে বলে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু দেখা যায় তার মধ্যে মৌসুমী বায়ু অন্যতম। আজকের আর্টিকেলে মৌসুমী বায়ু কাকে বলে-মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ঋতুর বৈচিত্র্যতা। যে বায়ু প্রবাহ বছরের ছয় মাস উত্তর-পূর্ব দিক হতে এবং ছয় মাস দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয় তাকে মৌসুমী বায়ু বলে।
১) গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ু,
২) শীতকালীন মৌসুমী বায়ু,
আরো পড়ুন: জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি বর্ণনা কর
আরো পড়ুন:জলবায়ুর উপাদান গুলো কি কি বর্ণনা কর
আরো পড়ুন:নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর
মৌসুমী বায়ু কাকে বলে
আরবী 'মওসুম'শব্দ হতে মৌসুমী শব্দের উৎপত্তি। মওসুম শব্দের অর্থ ঋতু।এ বায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে এর দিক পরিবর্তন হয়। আবার কারো কারো মতে এ মালয়ী শব্দ 'মনসিন'হতে উদ্ভব হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার যে বায়ুপ্রবাহ ছয়মাস উত্তর-পূর্ব দিক হতে এবং ছয়মাস দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে প্রবাহিত হয় তাকে মৌসুমী বায়ু বলে। আবার শীত ও গ্রীষ্মকালের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বায়ুপ্রবাহকে মৌসুমী বায়ু বলে। অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল ও শীতকালে স্থলভাগ ও জলভাগের উষ্ণতার তারতম্যের জন্য এ বায়ুর সৃষ্টি হয়। মৌসুমী বায়ু দুই প্রকার যেমন:
২) শীতকালীন মৌসুমী বায়ু,
গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ু
গ্রীষ্মকালে উত্তর গোলার্ধে কর্কটক্রান্তি রেখার ওপর সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয়। এতে মধ্য এশিয়া, উত্তর-পশ্চিম ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার স্থলভাগ উত্তপ্ত হয় এবং সেখানকার বায়ু উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এজন্য ঐ সময় নিম্ন চাপের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরের জলভাগ সেই সময় অপেক্ষাকৃত কম গরম থাকায় সেখানে উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়।এই উচ্চচাপযুক্ত জলভাগ এলাকা থেকে বায়ু এশিয়ার স্থলভাগে সৃষ্ট নিম্নচাপের দিকে প্রবাহিত হয়।
ফেরেলের সূত্রানুসারে নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে বেঁকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এ বায়ু বছরের এক নির্দিষ্ট সময়ে বা ঋতুতে প্রবাহিত হয় বলে একে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বলা হয়। এই বায়ু দীর্ঘপথ সমুদ্রের ওপর দিয়ে আসে বলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ থাকে এবং হিমালয় ও অন্যান্য উচ্চ পর্বতগাত্রে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
এর প্রভাবে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে এবং কৃষির উন্নতি হয়। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু দুটি শাখায় বিভক্ত, (ক) আরবসাগরীয় শাখা এবং (খ) বঙ্গোপসাগরীয় শাখা। আরবসাগরীয় শাখা আরব সাগর থেকে এবং বঙ্গোপসাগরীয় শাখা বঙ্গোপসাগর থেকে উৎপত্তি হয়।
শীতকালীন মৌসুমী বায়ু
সূর্যের দক্ষিণায়নের সাথে সাথে উত্তর গোলার্ধে উত্তাপ কমতে থাকে ও উচ্চচাপের সৃষ্টি হয়।এ সময় সূর্য দক্ষিণে মকরক্রান্তি রেখার নিকট অগ্রসর হয়ে লম্বভাবে কিরণ দেয়। ফলে মকরক্রান্তির নিকটবর্তী দেশগুলোতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়।এই সময় মধ্য এশিয়ার উচ্চচাপযুক্ত অঞ্চল থেকে শীতল, ভারী ও শুষ্ক বায়ু সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। একে উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু বলা হয়।
এ বায়ুর একটি অংশ জাপান সাগর ও বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করার পর যথাক্রমে জাপান ও তামিলনাডুতে বৃষ্টিপাত ঘটায়। উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ু নিরক্ষরেখা অতিক্রম করে দক্ষিণ গোলার্ধে এসে পৌঁছলে ফেরেলের সূত্র অনুসারে বেঁকে উত্তর-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু নামে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করে। সেখানে এ বায়ু গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী রূপে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়।
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান
মৌসুমী জলবায়ুর সর্বাধিক বিকাশ দেখা যায় এশিয়ায় বিশেষত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এশিয়ার বিশাল আয়তন, হিমালয়ের অবস্থান এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত উষ্ণ সমুদ্র স্থলভাগ ও জলভাগের মধ্যে তাপের ব্যাপক তারতম্য সৃষ্টি করে।এ বৈষম্যের জন্য মৌসুমী বায়ু প্রবাহের উৎপত্তি ঘটে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৌসুমী জলবায়ুর আওতাভুক্ত দেশগুলো হলো:আরো পড়ুন:নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা কর
ভারত,বাংলাদেশ,পাকিস্তান, নেপাল, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন। এছাড়া চীন, তাইওয়ান, জাপান, কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার উত্তর উপকূলেও মৌসুমী জলবায়ুর প্রভাব দেখা যায়। উষ্ণমণ্ডলীয় পশ্চিম আফ্রিকায় গ্রীষ্মকালে, গিনি উপকূলে অনুরূপ অক্ষাংশে অবস্থিত দক্ষিণ-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রেও মৌসুমী বায়ু দেখা যায়।
মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য
মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে:- ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ুর গতিপথ পরিবর্তন।
- সমুদ্রের ওপর দিয়ে প্রবাহিত গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ুতে সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়।
- বৃষ্টিপাত অনিয়মিত ও অনিশ্চিত।
- শীতকাল শুষ্ক ও বৃষ্টিহীন হলেও যে অঞ্চলে সমুদ্রের ওপর দিয়ে আগত বায়ু প্রবাহিত হয় সে অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হয়।
বৃষ্টিপাত
অধিকাংশ বৃষ্টিপাত গ্রীষ্মকালে অনুষ্ঠিত হয়। শীতকালে বৃষ্টিপাত অত্যন্ত কম। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২৫ থেকে ২০০ সেন্টিমিটার। অবস্থান ও ভূপ্রাকৃতিক কারণে বৃষ্টিপাতের তারতম্য পরিলক্ষিত হয়। সমুদ্রের ওপর দিয়ে আগত গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে নিয়ে আসে। এ বায়ু পর্বতগাত্রে বাধা পেয়ে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া পাহাড়ের চেরাপুঞ্জির নিকট মৌসিনরাম নামক স্থানে পৃথিবীর সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয়।
মেঘাচ্ছন্নতা
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে মেঘাচ্ছন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মেঘ এবং মেঘাচ্ছন্নতা পরিবর্তিত হয়ে এ অঞ্চলে মেঘের সংখ্যা আঁকার ও কভারেজ পরিবর্তন ঘটে। মেঘাচ্ছন্নতার কারণে অনেক সময় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি হয়।
তাপমাত্রা
আর্দ্র গ্রীষ্মকাল ও শুষ্ক শীতকাল মৌসুমি জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ২১°- ৩২° সেলসিয়াস এবং শীতকালীন গড় তাপমাত্রা ১০°-২১°সেলসিয়াস। শীত-গ্রীষ্মের তাপমাত্রার গড় পার্থক্য অনধিক ৫°সেলসিয়াস। উপকূল অঞ্চল হতে দেশের অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। বৃষ্টিপাতের কারনে গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা অত্যাধিক হয় না।
বায়ুর চাপ
মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে গ্রীষ্মকালে সূর্য রশ্মি লম্বভাবে পতিত হয় ফলে উত্তর-পশ্চিম ভারত ও মধ্য এশিয়ার স্থলভাগের উপর অত্যাধিক উষ্ণতায় গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়। আবার দেখা যায় শীতকালে সূর্যের দক্ষিণায়নের সঙ্গে উত্তর-পশ্চিম ভারত ও মধ্য এশিয়ার স্থলভাগের উষ্ণতা হ্রাস পেয়ে উচ্চচাপ কেন্দ্র সৃষ্টি হয়।
বায়ু প্রবাহ
মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চীন,জাপান,কোরিয়া প্রভৃতি মধ্য অক্ষাংশের অঞ্চলগুলোতে তাপের তারতম্যের জন্য শীত ও গ্রীষ্মে বিপরীতমুখী বায়ু প্রবাহিত হয়। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শীত-গ্রীষ্মে নিম্নচাপ কেন্দ্রের স্থান পরিবর্তনের ফলে বিপরীতমুখী বায়ু প্রবাহিত হয়।গ্রীষ্মকাল অপেক্ষায় শীতকালে বায়ুপ্রবাহ অনেক বেশি নিয়মিত ও শক্তিশালী।
মৌসুমী বিস্ফোরণ
কোন কোন বছর দেখা যায় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ভারত তথা অন্যান্য মৌসুমী বায়ুর প্রভাবিত অঞ্চল গুলিতে প্রচুর পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয় যা স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি। ফলস্বরূপ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একেই বলা হয় মৌসুমী বিস্ফোরণ। সাধারণত যে যে বছর প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনো উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না সে সে বছর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়।
মৌসুমী বায়ুর ছেদ বা বিরাম
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু আরব সাগরীয় শাখা হতে ভারতে প্রবেশ করে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু এই বৃষ্টি সব সময় একই রকম হয় না বলে কখনো কখনো ৭ থেকে ১৫ দিন বিরাম নেওয়ার পর আবার বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। একেই মৌসুমী বায়ুর ছেদ বা বিরাম বলা হয়।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে স্থল ও জলভাগে শীত ও গ্রীষ্মের তাপের তারতম্যের কারণে মৌসুমী বায়ু প্রবাহের সৃষ্টি হয়। গ্রীষ্মকালে এ বায়ু দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে এবং শীতকালে উত্তর-পূর্ব দিক হতে প্রবাহিত হয়। মৌসুমী জলবায়ু অধ্যুষিত অঞ্চল গুলিতে বছরের বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ঋতুর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে মৌসুমী বায়ু কাকে বলে-মৌসুমী জলবায়ুর প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহের সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।