সমুদ্রস্রোতের কারণ-সমুদ্রস্রোতের ফলাফল ব্যাখ্যা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন সমুদ্রস্রোতের কারণ-সমুদ্রস্রোতের ফলাফল সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে সমুদ্রস্রোতের কারণ-সমুদ্রস্রোতের ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
সমুদ্রের পানির নিয়মিত প্রবাহই স্রোত। বিভিন্ন কারণে এই সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। আজকের আর্টিকেলে সমুদ্রস্রোতের কারণ-সমুদ্রস্রোতের ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
সমুদ্রস্রোতের সংজ্ঞা
সমুদ্রের পানি কখনও এক স্থানে স্থির থাকে না। তা সর্বদা সমুদ্রের মধ্যে চলাচল করে। বায়ু যেমন সর্বদা এক স্থান হতে অন্য স্থানে যায়, সমুদ্রের পানিও সর্বদা এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। সমুদ্রের বা সাগর ও মহাসাগরের পানির নির্দিষ্ট ও নিয়মিত প্রবাহকে সমুদ্রস্রোত বলে। অর্থাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানের ঘনত্ব,তাপ ও চাপের তারতম্যের কারণে পানি রাশির উলম্ব ও আনুভূমিক ভারসাম্য রক্ষার্থে পানিরাশি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করে-আর এই চলমান প্রক্রিয়াই সমুদ্রস্রোত নামে আখ্যায়িত।
সমুদ্রস্রোতের কারণ
পানির স্বাভাবিক ধর্মই হচ্ছে তার উপরিভাগের সমতা রক্ষা করা। বিভিন্ন কারণে সমুদ্রের উপরিভাগের জলরাশির সমতার ব্যতিক্রম ঘটে। তখন পানির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে সমুদ্রের এক স্থানের পানি অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়। যেসব কারণে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়, তাদের বিবরণ নিচে দেয়া হল:
বায়ু প্রবাহ
সমুদ্রস্রোতের কারণ গুলোর মধ্যে বায়ু প্রবাহ অন্যতম। প্রধান স্রোতগুলোকে ভূপৃষ্ঠের প্রধান বায়ুপ্রবাহ গুলোর পথ অনুসরণ করতে দেখা যায়। অয়ন বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এবং পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। যেমন: উত্তর-পূর্ব অয়ন বায়ু ও দক্ষিণ-পূর্ব অয়ন বায়ুর প্রভাবে নিরক্ষীয় অঞ্চলে যথাক্রমে উত্তর নিরক্ষীয় স্রোত এবং দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতের উৎপত্তি হয়।
আবার দক্ষিণ-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরের উপসাগরীয় স্রোত এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কুরোশিও স্রোতদ্বয় উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। অনুরূপভাবে উত্তর-পশ্চিম পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে ব্রাজিল, নিউসাউথ ওয়েলস প্রভৃতি স্রোত দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বেঁকে কুমেরু স্রোতের সাথে মিলিত হয়। এমনকি ঋতুভেদে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে সমুদ্রস্রোতেরও দিক পরিবর্তিত হয়। এ কারণে মৌসুমী বায়ুর দিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভারত মহাসাগরীয় স্রোতের দিকও পরিবর্তিত হয়।
পৃথিবীর আবর্তন
পৃথিবীর আবর্তনের ফলেও সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয়। আহ্নিক গতির জন্য পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর সর্বদা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। পৃথিবীর এ আবর্তনের জন্য সমুদ্রের উপরিভাগের তরল পানি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে। এ কারণেই ফেরেল সূত্র অনুসারে সমুদ্রস্রোত উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।
যেমন: উত্তর গোলার্ধে উপসাগরীয় স্রোত ও ক্যানারী স্রোতের প্রবাহ ঘড়ির কাটার দিকে, অর্থাৎ ডান দিকে ঘুরে থাকে। অনুরূপভাবে দক্ষিণ গোলার্ধে ব্রাজিল স্রোতও পশ্চিমা বায়ুর প্রবাহজনিত কারণে ঘড়ির কাটার বিপরীত দিকে, অর্থাৎ বামবর্তে ঘুরে থাকে।
উষ্ণতার তারতম্য
সমুদ্রস্রোতের কারণ গুলোর মধ্যে উষ্ণতার তারতম্য একটি অন্যতম প্রধান কারণ। সমুদ্রের বিভিন্ন স্থানে উত্তাপের তারতম্যের দরুনও সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয় বলে সে স্থানে পানি উত্তপ্ত হয়। কিন্তু মেরু প্রদেশে সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ে বলে ঐ স্থানের পানি শীতল থাকে।
নিরক্ষীয় অঞ্চলে উষ্ণ পানি আয়তনে বৃদ্ধি পেয়ে হালকা হয় এবং সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে থাকে। পক্ষান্তরে পানির সমতা রক্ষার্থে মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী পানি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে নিরক্ষপ্রদেশে আসতে থাকে। এরূপে একটি স্রোত চক্রের উৎপত্তি হয়।
লবণাক্ততার তারতম্য
সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা সর্বত্র সমান নয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততার তারতম্য ঘটে থাকে। অধিক লবণাক্ত পানি কম লবণাক্ত পানি অপেক্ষা ঘন ও ভারী। এজন্য সমুদ্রের কোন অংশের পানির লবণাক্ততা বেড়ে গেলে সেখানে লবণাক্ত ভারী পানি সমুদ্রের নিচ দিয়ে কম লবণাক্ত অংশের দিকে অন্তঃস্রোতরূপে প্রবাহিত হয়।আবার কম লবণাক্ত অংশের পানি পৃষ্ঠস্রোতরূপে অধিক লবণাক্ত অংশের দিকে প্রবাহিত হয়। ভূমধ্যসাগরের পানি অধিক লবণাক্ত হওয়ায় আটলান্টিকের কম লবণাক্ত পানি জিব্রাল্টার প্রণালী দিয়ে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করে।
বাষ্পীভবনের তারতম্য
বাষ্পীভবনের তারতম্য সমুদ্রস্রোতের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। উত্তাপের পার্থক্যের ওপর বাষ্পীভবনের তারতম্য নির্ভর করে। অধিক বাষ্পীভবনের ফলে কোন স্থানে পানির সমতা নষ্ট হলে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। স্থলভাগ বেষ্টিত সাগরগুলোতে বাষ্পীভবনের তারতম্য সমুদ্রস্রোত সৃষ্টিতে সর্বাধিক সহায়তা করে। ক্রান্তীয় ও উপক্রান্তীয় অঞ্চলে স্থলভাগ দ্বারা বেষ্টিত প্রণালী দ্বারা সংযুক্ত সাগর গুলোতে বাষ্পীভবনের তারতম্যের ফলে পরস্পরের মধ্যে স্রোতের সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রের গভীরতা
সমুদ্রের গভীরতার জন্যও সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি হয়। সমুদ্রের গভীরতার পার্থক্যের জন্য উষ্ণতার তারতম্য ঘটে। সমুদ্র যদি অগভীর হয় তবে তার পানি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উপরে উঠে এবং শীতল পানি নিচে নেমে যায়। এতে ঊর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী স্রোতের সৃষ্টি হয়।
আবার গভীর সমুদ্রের ভিন্ন প্রবাহ দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে সূর্যের কিরণ সমুদ্রের ২১০ মিটারের অধিক গভীরে প্রবেশ করতে পারেনা। ফলে উক্ত গভীরতার পর সমুদ্রের পানির উষ্ণতা ক্রমশ কম হতে থাকে। এতে গভীর সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্ঠস্রোত এবং তলদেশ দিয়ে অন্তঃস্রোত প্রবাহিত হয়।
স্থলভাগের অবস্থান
সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হওয়ার সময় তার সম্মুখে কোন স্থলভাগ থাকলে স্রোতের দিক পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্রোতের উৎপত্তি হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের দক্ষিণ নিরক্ষীয় স্রোতটি দক্ষিণ আমেরিকার সেন্ট রক অন্তরীপে বাধা পেয়ে তা দুইটি নতুন স্রোতের সৃষ্টি করে। স্থলভাগ না থাকলে এর স্রোতটি সোজা পশ্চিম দিকে চলে যেত।
পশ্চিমা বায়ুর প্রভাবে কুমেরু স্রোতের একটি শাখা আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে বাধা পাওয়ায় বেঙ্গুয়েলা স্রোতের উৎপত্তি হয়েছে। অনুরূপভাবে স্থলভাগের অবস্থানের ফলে দক্ষিণে প্রশান্ত মহাসাগরে পেরু এবং ভারত মহাসাগরে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। তাই দেখা যায়,কতিপয় সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তির মূলে রয়েছে স্থলভাগের অবস্থান।
অক্ষাংশিক অবস্থান ও স্রোতচক্র
অক্ষাংশিক অবস্থান সমুদ্রস্রোত বিশেষত: মহাসাগরের স্রোতচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমুদ্রস্রোত সমূহ উচ্চ অক্ষাংশ হতে নিম্ন অক্ষাংশে গমন করে এবং পরবর্তীতে আয়নবায়ু দ্বারা তাড়িত হয়ে চক্রাকারে প্রবাহিত হয়। মূলত: উচ্চ অক্ষাংশে শৈত্যের কারণে পানি রাশির উচ্চতা এবং নিম্ন অক্ষাংশে অধিক সূর্যকিরণে অত্যাধিক বাষ্পীভবন জনিত পানিস্বল্পতার কারণেই সমতা রক্ষার্থে স্রোতসমূহ সৃষ্টি হয়ে থাকে।তবে অনেক ক্ষেত্রে নিম্ন অক্ষাংশের উষ্ণ স্রোত হালকা হয়ে পৃষ্ঠ প্রবাহ রূপে উচ্চ অক্ষাংশে গমন করছে।
অক্ষাংশিক অবস্থান ছাড়াও অন্যবিধ কারণে অধিক বাষ্পীভবন ও তাপমাত্রার পার্থক্য হতে পারে এবং সমুদ্রের পানির লবণাক্ততারও প্রভেদ থাকে। এক্ষেত্রে পানির ঘনত্বের তারতম্য ঘটলে কম ঘনত্বের পানি পৃষ্ঠস্রোত এবং অধিক ঘনত্বের পানি অন্তঃস্রোত হিসেবে প্রবাহিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভূমধ্যসাগরের প্রায় চতুর্দিকে স্থলভাগ থাকায় সেখানে তাপমাত্রা পার্শ্ববর্তী উন্মুক্ত মহাসাগরের তুলনায় অনেক বেশি।
এক্ষেত্রে বাষ্পীভবন হয় মাত্রাতিরিক্ত। অনিবার্য ফল হিসাবে লবণাক্ততা বেড়ে যায় এবং পানির ঘনত্বও বেড়ে যায়। এই ভূ-অবস্থানগত কারণে ভূমধ্যসাগরের পানির উচ্চতা হ্রাস পায় এবং পার্শ্ববর্তী আটলান্টিক মহাসাগর থেকে স্রোত ভূমধ্যসাগর অভিমুখে প্রবাহিত হয়। আবার ভূমধ্যসাগরের ভারী পানি অন্তঃস্রোত হিসেবে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে প্রবাহিত হয়।
ঘনত্বের তারতম্য
যেকোনো কারণে পানির ঘনত্ব বাড়লে তার পৃষ্ঠ উচ্চতা হ্রাস পায় এবং কম ঘনত্ব বিশিষ্ট পানি থেকে ঐ এলাকার দিকে স্রোত প্রবাহিত হয়। তাপমাত্রা, বাষ্পীভবন, লবণাক্ততা কিংবা অন্যান্য স্থানীয় কারণে ঘনত্বের পার্থক্য সৃষ্টি হয়। সুতরাং ঘনত্বের তারতম্য সমুদ্রস্রোতের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
বায়ুর চাপ
সমুদ্রপৃষ্ঠে নিয়মিত স্রোত ছাড়াও অঞ্চল ভিত্তিক অনিয়মিত ও ঋতু ভিত্তিক স্রোত প্রবাহিত হয়। সমুদ্রের ওপর বায়ুমন্ডলের নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে পানির উচ্চতা বেড়ে যায় ও উচ্চচাপ এলাকায় উচ্চতা কমে যায়। এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার জন্য স্রোত সৃষ্টি হয়। সুতরাং বায়ুর চাপ সমুদ্রস্রোতের কারণ হিসেবে চিহ্নিত।
বরফ গলন
মেরু অঞ্চলে বরফ গলনের ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্রোত সৃষ্টি হয়। গ্রীনল্যান্ড ও বেরিং স্রোত এভাবে সৃষ্ট। ঐ স্রোত গুলো উচ্চ থেকে নিম্ন অক্ষাংশের দিকে প্রবাহিত হয়। সুতরাং বরফ গলন সমুদ্রস্রোতের কারণ হিসেবে বিবেচিত।
সমুদ্রতলের ভূপ্রকৃতি
সমুদ্র তলদেশের স্রোতের সম্পর্কে উপরিস্থির স্রোতের মতো বিস্তারিত জানা না গেলেও বলা যায়, তলদেশের বন্ধুরতা স্রোতের গতি পরিবর্তন করে।
তাপমাত্রার পার্থক্য
তাপমাত্রার আঞ্চলিক পার্থক্য স্রোতের সূচনা করতে পারে। কম তাপমাত্রাযুক্ত এলাকায় পানি ভারী এবং বেশি তাপমাত্রাযুক্ত এলাকায় পানি হালকা হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে উভয় দিকের মধ্যে পৃষ্ঠ ও অন্তঃস্রোত সৃষ্টি হয় সমতা রক্ষার জন্য।
সমুদ্রস্রোতের ফলাফল
সমুদ্রস্রোতের ফলাফল বিভিন্ন রূপে দেখতে পাওয়া যায়। পৃথিবীর নানা স্থানে উষ্ণ ও শীতল স্রোতের প্রভাব বিশেষ লক্ষণীয়। এসব সমুদ্রস্রোতকে মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। দেশের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সমুদ্রস্রোতের অধিক প্রভাব রয়েছে। নিম্নে সমুদ্রস্রোতের ফলাফল বর্ণনা করা হলো:
১)ভূ-প্রকৃতির ওপর প্রভাব
মহীসোপান এলাকার উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে হিমবাহের গলনের ফলে কাঁকর, নুড়ি,কর্দম প্রভৃতি অবক্ষেপিত হয়ে মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। এছাড়া উপকূলীয় এলাকায় স্রোতের আঘাতে গহব্বর, ক্লিফ প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে।
২)জলবায়ুর ওপর প্রভাব
বায়ুমন্ডলে উষ্ণতার তারতম্য
সমুদ্রস্রোত সমুদ্রের উপরস্থ বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতার তারতম্য ঘটায়। যে সব দেশের নিকট দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয় সে সব দেশের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়, কিন্তু শীতল সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হলে জলবায়ু অপেক্ষাকৃত শীতল হয়। শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স নদী ও তার মোহনা বছরের প্রায় ৯ মাসই বরফাবৃত থাকে।
কিন্তু উষ্ণ মহাসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে একই অক্ষাংশে অবস্থিত ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূল অঞ্চল সর্বদা বরফমুক্ত থাকে। নিউইয়র্ক লন্ডন হতে দক্ষিণে অবস্থিত হলেও নিউইয়র্কের পার্শ্ব দিয়ে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত প্রবাহিত হয় বলে সেখানে শীতকালে লন্ডন অপেক্ষা বেশি শীত অনুভূত হয়।
বৃষ্টিপাত
উষ্ণ স্রোতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে অধিক জলীয়বাষ্প থাকায় এই বায়ু স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বৃষ্টিপাত ঘটায়। অন্যদিকে শীতল স্রোতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে জলীয়বাষ্প না থাকায় বৃষ্টিপাত হয় না বরং তুষারপাত ঘটায়। যেমন,আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে বৃষ্টিপাত বেশি হয়। কিন্তু শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের জন্য ল্যাব্রাডর উপকূলে তুষারপাত অধিক হয়।
কুয়াশা ও ঝড়ের সৃষ্টি
উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে এদের পরস্পরের তাপের বেশি পার্থক্যের জন্য এবং অতি অল্প স্থানে বেশি তাপের পরিবর্তনের ফলে কুয়াশা ও ঝড়-বৃষ্টি অনুষ্ঠিত হয়। এজন্য নিউফাউন্ডল্যান্ড ও জাপানের পূর্ব উপকূলে কুয়াশা ও ঝড় দেখতে পাওয়া যায়। এরূপ আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে নৌচলাচলের বিপদের সম্ভাবনা থাকে।
৩)ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর প্রভাব
ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব নিচে বর্ণনা করা হলো:
বরফযুক্ত বন্দর
নাতিশীতোষ্ণ এবং হিমমন্ডলের অনেক সমুদ্রে শীতকালে পানি জমে বরফ হয়ে যায়। এরূপ অঞ্চলে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে সমুদ্রের পানি বরফে পরিণত হতে পারে না। উপসাগরীয় উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে নরওয়ের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে শীতকালেও বরফ জমে না। এতে এ অঞ্চলের বন্দরগুলোর পথ বন্ধ হতে পারেনা এবং সারা বছর ব্যবসা-বাণিজ্য চলে।
উষ্ণ জাপান বা কুরোশিও স্রোতের জন্য কানাডার পশ্চিম উপকূলও বরফ মুক্ত থাকে। সুমেরু শীতল স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার ল্যাব্রাডর উপদ্বীপের বন্দরগুলো বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফে আচ্ছাদিত থাকে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বিঘ্ন ঘটে।
জাহাজ চলাচল
- সামুদ্রিক জাহাজ চলাচলের ওপর সমুদ্রস্রোতের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালিয়ে শীঘ্র গন্তব্য স্থানে যাওয়া যায়। এতে মালপত্র রপ্তানি ও আমদানি করা সহজ হয়। কিন্তু প্রতিকূলে জাহাজ চালানা করলে অধিক সময় লাগে। এ কারণে উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের পথে জাহাজ চালিয়ে অল্প সময়ে আমেরিকা থেকে ইউরোপ যাওয়া যায়। কিন্তু এ পথে ইউরোপ থেকে আমেরিকা আসতে বহু সময় লাগে।
- প্রাচীনকালে পালের জাহাজগুলো সর্বদা সমুদ্রস্রোত অনুসরণ করে এক স্থান হতে অন্য স্থানে চলাচল করতো। সেকালে পশ্চিম ইউরোপের বন্দরগুলো হতে পালের জাহাজগুলো ক্যানারি ও উত্তর নিরক্ষীয় স্রোতের টানে সহজেই উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে গিয়ে পৌঁছত। ফেরার সময় উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের সাহায্যে উত্তর আটলান্টিক স্রোত বরাবর ইউরোপে ফিরে যেত।
- অনুরূপভাবে শীতকালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাহাজগুলো রপ্তানি সামগ্রী নিয়ে ভারত মহাসাগরীয় উত্তর-পূর্ব মৌসুমি স্রোতের সাহায্যে আরব,ইরান প্রভৃতি দেশে পৌঁছত এবং গ্রীষ্মকালে স্রোতের গতি পরিবর্তিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি স্রোতের উৎপত্তি হলে স্রোতের অনুকূলে আমদানি সামগ্রী নিয়ে ফিরে আসতো।
- উষ্ণ স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালানো নিরাপদ, কিন্তু শীতল স্রোতের গতিপথে হিমশৈল প্রভৃতির জন্য জাহাজ চালাতে অসুবিধা হয়, এজন্য আটলান্টিক উষ্ণ স্রোতের অনুকূলে বাণিজ্য পণ্য নিয়ে সর্বাধিক জাহাজ চলাচল করতো। এর ফলে আটলান্টিকের উভয় উপকূল ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নত।
মগ্নচড়ার সৃষ্টি
উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে শীতল স্রোত উষ্ণ হওয়ায় এর সাথে প্রবাহিত হিমশৈল,বালি, কাঁকর ও নুড়ি প্রভৃতি সমুদ্রের তলদেশে সঞ্চিত হয়ে মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। এরূপ মগ্নচড়ায় প্রচুর মৎস্যের সমাগম হয় এবং সেখানে মৎস্য শিকার ও মৎস্য ব্যবসা গড়ে ওঠে। নিউফাউন্ডল্যান্ডেরও নিকটবর্তী গ্রান্ড ব্যাঙ্ক নামক মগ্নচড়াটি এভাবে সৃষ্টি হয়েছে।
মৎস্য ব্যবসা
শীতল স্রোতের সাথে প্রচুর মাছ আসে এবং উষ্ণ স্রোতের সাথে শীতল স্রোত যেখানে মিলিত হয় মাছগুলো সেখানে থেকে যায়। কারণ এরূপ স্থানেও সমুদ্রে মৎস্য খাদ্য প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এ কারণেই নিউফাউন্ডল্যান্ড, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জ,নরওয়ে ও জাপানের উপকূলে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। তাই ঐ সব অঞ্চল মৎস্য শিকার ও মৎস্য ব্যবসায় প্রভূত উন্নতি লাভ করেছে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে ওপরিভাগের সমতা রক্ষা পানির স্বাভাবিক ধর্ম। বিভিন্ন কারণে পানির ওপরিভাগের সমতা নষ্ট হয়। ফলে সমুদ্রের পানি এক স্থান হতে অন্য স্থানে প্রবাহিত হয়ে স্রোতের সৃষ্টি করে। এছাড়াও সমুদ্রস্রোতের ফলাফল মানুষের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়তে দেখা যায়। আজকের আর্টিকেলে সমুদ্রস্রোতের কারণ-সমুদ্রস্রোতের ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।