জোয়ার-ভাটার কারণ ও ফলাফল বর্ণনা কর
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন জোয়ার-ভাটার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে জোয়ার ভাটার-কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
জোয়ার-ভাটা সমুদ্রের নিত্য কাজ। একটি সমুদ্র উপত্যকার একদিকে জোয়ারের ফলে পানির উত্থান ঘটে এবং অপরদিকে পানির অবনমন ঘটে। জোয়ার-ভাটার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হলো। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।
জোয়ার-ভাটার সংজ্ঞা
চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণ শক্তি এবং পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ শক্তি প্রভৃতির কারণে সমুদ্রের পানি নির্দিষ্ট সময় অন্তর এক জায়গায় ফুলে ওঠে, আবার অন্য জায়গায় নেমে যায়। সমুদ্র পানির এভাবে ফুলে ওঠাকে জোয়ার এবং নেমে যাওয়াকে ভাটা বলে।Trujillo (১৯৯৯)-এর মতে,"জোয়ার-ভাটা হলো সমুদ্রের পানির নির্দিষ্ট অবস্থান বা সমুদ্র সমতল থেকে পানির নিয়মিত নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী ওঠা নামা।"সমুদ্রের পানির এই ওঠা নামা মূলত: চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণেই হয়ে থাকে। তবে অন্যান্য জ্যোতিষ্ক গুলোর আকর্ষণও কিছুটা কাজ করে।সমুদ্রের এক জায়গায় প্রতিদিন দুইবার জোয়ার ও দুইবার ভাটা হয়।
জোয়ার ভাটা সমুদ্রপৃষ্ঠে ও সমুদ্রের মোহনা থেকে নদীপথে কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যায়। সমুদ্রের মধ্যভাগে পানি সাধারণত ৩০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার ওঠানামা করে, কিন্তু উপকূলের নিকট সাগর-উপসাগরের গভীরতা কম বলে সেখানে জলরাশি অনেক বেশি ওঠানামা করে। এ কারণেই সমুদ্রের মোহনা থেকে নদী সমূহের অভ্যন্তরে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত জোয়ার ভাটা হয়ে থাকে। নিম্নে জোয়ার-ভাটার কারণ ও ফলাফল বর্ণনা করা হলো:
জোয়ার-ভাটার কারণ
বর্তমানে বিজ্ঞানিগণ প্রমাণ করেছেন যে, পৃথিবীর ওপর চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ এবং পৃথিবীর আবর্তনের ফলে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে জোয়ার-ভাটা হয়। অর্থাৎ জোয়ার-ভাটার কারণ মূলত দুইটি। যেমন:
১) মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাব
২) কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাব
১) মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাব
পৃথিবীর সকল পদার্থের আকর্ষণ শক্তি আছে এবং একটি অপরটিকে আকর্ষণ করছে। এ আকর্ষণকে মহাকর্ষ বলে। এ আকর্ষণের ফলে পৃথিবী সর্বদা সূর্যের চারিদিকে এবং চন্দ্র সর্বদা পৃথিবীর চারিদিকে ঘুরছে। এ আকর্ষণ শক্তির ফলেই ভূপৃষ্ঠে জলরাশি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। পৃথিবীর সব পদার্থের আকর্ষণ শক্তি একরূপ নয়।
যে পদার্থ যত বড়, তার আকর্ষণ করার শক্তিও তত বেশি। কিন্তু দূরত্ব বৃদ্ধি পেলে আকর্ষণ শক্তি কমে যায়। সূর্য ও চন্দ্র পৃথিবীকে এবং পৃথিবীর প্রতিটি পদার্থকে সর্বদাই আকর্ষণ করছে। চন্দ্র পৃথিবীর নিকটতম জ্যোতিষ্ক। এজন্য পৃথিবীর ওপর এর আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি।
সূর্য চন্দ্র অপেক্ষা ২ কোটি ৬০ লক্ষ গুণ বড় এবং পৃথিবী অপেক্ষা ১৩ লক্ষ গুণ বড় হলেও পৃথিবীর সূর্য হতে গড়ে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কিন্তু পৃথিবী থেকে চন্দ্রের গড় দূরত্ব মাত্র ৩৮.৪ লক্ষ কিলোমিটার। এ কারণে পৃথিবীর ওপর সূর্যের আকর্ষণ শক্তি চন্দ্র অপেক্ষা অনেক কম।
ফলে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারে সূর্য অপেক্ষা চন্দ্রের প্রভাব বেশি। হিসাব করে দেখা গেছে যে, জোয়ার উৎপাদনে সূর্যের ক্ষমতা চন্দ্রের ৪/৯ ভাগ। অতএব এটা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে, জোয়ার-ভাটার ক্ষেত্রে চন্দ্র ও সূর্য উভয়ই পৃথিবীর ওপর নিজ নিজ শক্তি প্রয়োগ করলেও চন্দ্রের শক্তিই অধিক কার্যকরী।
চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ শক্তি স্থলভাগের কেন্দ্রস্থলে ও ভূপৃষ্ঠের জলরাশির ওপর অধিক কার্যকরী হয়। স্থলভাগের ওপরের দিকে চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ শক্তি নেই বললেই চলে। এ কারণে পৃথিবীর কেন্দ্র ও পানির উপরিভাগের ওপর চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণের পার্থক্যের জন্য জোয়ার -ভাটা সংঘটিত হয়।
২) কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাব
কেবল মহাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই জোয়ার সৃষ্টি হয় না। আবর্তনশীল পৃথিবী পৃষ্ঠে যে কেন্দ্রাতিগ শক্তি উৎপন্ন হয় তাও জোয়ার সৃষ্টিতে বিশেষত গৌণ জোয়ার সৃষ্টিতে সাহায্য করে থাকে। কাদা-পানিযুক্ত কোন রাস্তা দিয়ে যখন কোন গাড়ির দ্রুত বেগে অগ্রসর হয় তখন তার চাকা হতে কাদা-পানি চারিদিকে ছিটকে যায়।
অনুরূপভাবে পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর থেকে দ্রুত আবর্তন করছে বলে তার পৃষ্ঠ হতে তরল জলরাশিও চারিদিকে ছিটকে যাওয়ার প্রবণতা লাভ করছে। এটাই কেন্দ্রাতিগ শক্তি বা কেন্দ্রাবিমুখী শক্তি। এটাও জোয়ারের অন্যতম কারণ।
তবে কেন্দ্রাতিগ শক্তি অপেক্ষা চন্দ্রের আকর্ষণ শক্তি জোয়ারের জন্য বেশি কার্যকরী অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। কারণ কেন্দ্রাতিগ শক্তি ভূপৃষ্ঠের চারপার্শ্বে কার্যকর অথচ চন্দ্রের আকর্ষণ শক্তি প্রধানত একদিকে অধিক কার্যকর।
জোয়ার-ভাটার ফলাফল
মানুষের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর জোয়ার-ভাটার যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। এর ফলে মানুষ নানা ভাবে উপকৃত হয়ে থাকে। নিম্নে জোয়ার-ভাটার কিছু ইতিবাচক প্রভাব উল্লেখ করা হলো:
বন্দরের সুবিধা
জোয়ারের সময় পানি বৃদ্ধি পায় বলে সমুদ্রগামী জাহাজের পক্ষে নদীবন্দরে প্রবেশে সুবিধা হয়। আবার ভাটার স্রোতের সাথে ঐ জাহাজ অনায়াসে সমুদ্রে এসে পড়ে। চট্টগ্রাম, মংলা, কলকাতা, লন্ডন প্রভৃতি বন্দরে জোয়ারের সময় জাহাজ বন্দরে প্রবেশ করে এবং ভাটার সময় সমুদ্রে বের হয়ে আসে।
নদীবন্দর বরফ মুক্ত থাকা
জোয়ার-ভাটার ফলে নদীর পানি স্বল্প পরিমাণে লবণাক্ত হওয়ায় শীতে সহজে জমে যায় না। ফলে নাতিশীতোষ্ণ মণ্ডলেও শীতে নদীর পানি জমে না এবং নৌচলাচলের যোগ্য থাকে। এ কারণেই ইংল্যান্ডের অনেক নদীবন্দর ১২ মাস বরফমুক্ত থাকে।
নদীর পানি নির্মল থাকা
জোয়ার-ভাটার ফলে নদীর পানি নির্মল থাকে। দৈনিক দুইবার করে জোয়ার-ভাটা হওয়ার ফলে নদীতে সঞ্চিত সব আবর্জনা ধুয়ে মুছে যায়।
লবণ উৎপাদন কেন্দ্র
জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর করে সমুদ্র উপকূলে লবণ তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের পানি লবণ উৎপাদন কেন্দ্রের অগভীর চওড়া জলাশয়ে প্রবেশ করে। পরে ঐ আবদ্ধ পানিরাশিকে শুকিয়ে লবণ তৈরি করা হয়।
নদী মুখ নৌচলাচলের যোগ্য থাকা
জোয়ার-ভাটার জন্য পলিমাটি পড়ে নদীর মুখ বন্ধ হয়ে যেতে পারে না। ফলের নৌচলাচলের যোগ্য থাকে। ইংল্যান্ডের টেমস নদীতে জোয়ার-ভাটার ফলে পলি জমতে পারে না বলে সর্বদা নাব্য থাকে।
বনাঞ্চল গড়ে ওঠা
নির্দিষ্ট সময় অন্তর জোয়ার-ভাটা হওয়াতে উপকূলীয় এলাকায় বিশেষ ধরনের বনাঞ্চল গড়ে উঠে যা' অন্যত্র হয় না। এই ধরনের বন উপকূলীয় স্রোতজ বৃক্ষের বন বা গরনে বনাঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সুন্দরবন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মানুষের নানাবিধ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এই বনের গুরুত্ব অপরিসীম।
পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন করা
জোয়ার শক্তি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীর অনেক অংশে বিরাট আকারের জলাধার নির্মাণ করে জোয়ারের সময় পানিতে ভর্তি করে রাখা হয়। ভাটার সময় ঐ পানি শুরু পথে নিচে নির্গত করে টারবাইনের সাহায্যে পানি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।
১৯৬৬ সালে ফ্রান্সের লা-রান্স ফাঁড়িতে সর্বপ্রথম জোয়ার-ভাটার বৈদ্যুতিক শক্তি কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়, যার প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ১০ হাজার কিলোওয়াট। বর্তমানে এখান থেকে বার্ষিক ৮০ লক্ষ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। রাশিয়ার হোয়াইট সী এবং কানাডার ফুন্ডি বে অঞ্চলে জোয়ার-ভাটার শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।
চিনেও জোয়ার-ভাটা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। ভারতের কান্ডালা বন্দরেও অনুরূপভাবে একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে সুন্দরবন অঞ্চলের খাড়িগুলোতে জোয়ার-ভাটার সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
নারিকেল ও সুপারি গাছের আধিক্য
জোয়ারের সময় মৃত্তিকাতে লবণাক্ততা সৃষ্টি হওয়ায় নারিকেল ও সুপারি জন্মানোর সহায়ক অবস্থা সৃষ্টি হয়। এজন্য উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর নারিকেল ও সুপারি গাছ দৃষ্টিগোচর হয়।
মৎস্য উৎপাদন
জোয়ারের সময় সমুদ্র থেকে প্রচুর মৎস্য নিকটবর্তী মোহনা, খাড়ি অথবা নদী অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ফলে এ সময় সহজে প্রচুর মৎস্য ধৃত হয়। এছাড়াও উপকূলে জোয়ারের লবণাক্ত পানি আটকে চিংড়ির হ্যাচারি ও পরবর্তীতে লবণাক্ত পানির জলাশয়ে চিংড়ি চাষ করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে এই চিংড়ি অন্যতম প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।
জোয়ার-ভাটার নেতিবাচক প্রভাব
জোয়ার-ভাটার বিভিন্ন উপকারিতা ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। যেমন:
১)জোয়ারের বানে অনেক ছোট ছোট নৌযান ডুবে যায় এবং প্রাণ ও সম্পদহানি ঘটে। উপকূলীয় শস্যক্ষেত্রে আকস্মিকভাবে বানের পানি প্রবেশ করে শস্যহানি ঘটায়। অনেক সময় জোয়ারের বানে চিংড়ির হ্যাচারিসহ মৎস্যক্ষেত্র ভেসে যায়।
২)ভাটার সময় নৌযানসমূহ চড়ায় আটকা পড়ে। ফলে জোয়ার আসা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় নৌচলাচল বন্ধ থাকে। এছাড়াও মাঝে মাঝে প্রলয় জোয়ারে উপকূলের লবণাক্ততা স্থলভাগের অভ্যন্তরীণ এলাকায় ঢুকে ফসল ও মৎস্য চাষের ক্ষতি করে।
৩)কিছু কিছু ক্ষতিকর দিক থাকা সত্ত্বেও এ কথা অনস্বীকার্য যে, জোয়ার-ভাটা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
শেষ কথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে মহাকর্ষ শক্তির প্রভাবে সমুদ্রের পানির ওঠানামাকেই এক কথায় জোয়ার-ভাটা বলা যায়। পানি যখন ফুলে উঠে সমুদ্র থেকে তীরভূমির দিকে অগ্রসর হয় তখন সেটি জোয়ার এবং যখন পানি তীরভূমি থেকে সমুদ্রের দিকে পশ্চাদপসরণ করে তখন সেই অবস্থা ভাটা হিসেবে পরিচিত। আজকের আর্টিকেলে জোয়ার-ভাটার কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।