বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি। আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানানো হবে। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি

পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে উর্ধ্ব দিকে যে বায়বীয় আবরণ সমগ্র পৃথিবীকে বেষ্টন করে থাকে তাকেই বায়ুমণ্ডল বলে। বায়ুমণ্ডল নানা প্রকার গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা গঠিত। বায়ু আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু স্পর্শ দ্বারা অনুভব করতে পারি। আর এই বায়ুমণ্ডলের স্তরগুলো একের পর এক সাজানো রয়েছে। সুতরাং আজকের আর্টিকেলে বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করব।

বায়ুমণ্ডল কি

আমাদের এই পৃথিবী নানা প্রকার গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা পরিবেষ্টিত। এইসব গ্যাসীয় উপাদানের সমষ্টিকে সাধারণভাবে বায়ু বলে। সুতরাং যে অদৃশ্য বায়ু বা গ্যাসীয় উপাদানের পুরু আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে রয়েছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে এই মন্ডলটি পৃথিবীর গায়ে লেগে রয়েছে এবং এর সাথে আবর্তন করছে।


বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সমমন্ডল ও বিষম মন্ডল নামে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন, বিশেষ করে গ্যাসীয় অনুপাত প্রায় একই রূপে থাকে বলে বায়ুমণ্ডলের এই নিম্নাংশ সমমন্ডল বা হোমোস্ফিয়ার নামে পরিচিত। পক্ষান্তরে, এই স্তরের উপরের অংশে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাতের বিভিন্নতা এবং স্থানভেদে স্তর গুলোর দূরত্ব আলাদা হওয়ায় এটি বিষমমন্ডল বা হেট্যারোস্ফিয়ার নামে পরিচিত।

বায়ুমন্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি

বায়ুমণ্ডল প্রধানত দুইটি স্তরে বিভক্ত। যেমন সমমন্ডল বা হোমোস্ফিয়ার এবং বিষমমন্ডল বা হেট্যারোস্ফিয়ার। ভূপৃষ্ঠ হতে প্রায় ৯০ কিলোমিটার অবধি বায়ুস্তরে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত সমান থাকে। তাই এ স্তরটিকে সমমন্ডল বলে। সমমন্ডলের উপরের স্তরে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত সমান থাকে না, তাই এই স্তরটিকে বিষমমন্ডল বলা হয়। এটি প্রায় ৯০ কিলোমিটার থেকে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত।

ক)সমমন্ডল

বায়ুর তাপমাত্রা ও উপাদানের বিভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে সমমন্ডলকে কতকগুলো স্তরে বিভক্ত করা হয়েছে।যেমন:

১)ট্রপোস্ফিয়ার

ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন স্তরটিকে ট্রপোস্ফিয়ার বলা হয়। এর গভীরতা পৃথিবীর চারিদিকে সর্বত্র এবং সর্বদা সমান থাকে না। ঋতুভেদে এবং ভিন্ন ভিন্ন অক্ষাংশে এর গভীরতার পার্থক্য হয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এর গভীরতা ১৮ কিলোমিটার ধরা হলেও মেরুর নিকট প্রায় ৯.৫ কিলোমিটার বলে অনুমান করা হয়। তবে এর গড় গভীরতা প্রায় ১৩ কিলোমিটার। এ স্তরে প্রতি ১০০ মিটার উচ্চতার জন্য প্রায় ০.৬৪°সেলসিয়াস উষ্ণতা হ্রাস পায়। অর্থাৎ প্রতি ৩০০ মিটারে প্রায় ১.৯°সেলসিয়াস উষ্ণতা হ্রাস পায়। বায়ুর এ স্তর মানুষের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় স্তর।


কারণ,এ স্তরের নিম্নভাগে মানুষসহ সকল প্রকার প্রাণী ও উদ্ভিদের বাসস্থান এবং মেঘ, বৃষ্টিপাত, বায়ুপ্রবাহ, কুয়াশা, ঝড়, বজ্রবিদ্যুৎ প্রভৃতি সবকিছুই ঘটে থাকে। এখানে উত্তাপের সর্বাপেক্ষা অধিক ব্যতিক্রম ঘটে এবং তাপ ও চাপের পার্থক্যর কারণে বায়ুপ্রবাহের সৃষ্টি হয়। ট্রপোস্ফিয়ারের উর্ধ্বসীমাকে ট্রপোপজ বলে। ট্রপোপজের গভীরতা অতি নগণ্য।এ সরু অঞ্চলে বায়ু স্থির এবং উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতার হ্রাস বৃদ্ধি হয় না বলে একে সমোষ্ণ অঞ্চল বলা হয়। ঝড় বৃষ্টির প্রাদুর্ভাব নেই বলে বিমান এই স্তরে বিনা বাধায় চলাচল করে।

২)স্ট্রাটোস্ফিয়ার

ট্রপোপজের ওপরে বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তরটিকে স্ট্রাটোস্ফিয়ার বলা হয়।ট্রপোপজ হতে ওপরের দিকে এর বিস্তার প্রায় ৩৩ কিলোমিটার (অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১৭ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব থেকে ৫০ কিলোমিটার উর্ধ্বে পর্যন্ত বিস্তৃত) এ স্তরে উচ্চতা অনুযায়ী উষ্ণতা হ্রাস পায় না বরং বৃদ্ধি পায়। এখানকার বায়ুতে ধূলিকণা ও জলীয়বাষ্পের পরিমাণ অতি নগণ্য এবং মেঘ প্রায় দেখাই যায় না। এই স্তরের ওপরের অংশকে ওজোনোস্ফিয়ার ও মেসোস্ফিয়ারে পৃথক করা হয়।

৩)ওজোনোস্ফিয়ার

স্ট্রাটোস্ফিয়ারের ওপরে ওজোন গ্যাসের স্তরটিকে ওজোনোস্ফিয়ার বলা হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে ২০-৫০ কিলোমিটার উচ্চতার মধ্যে এই স্তরটি দেখা যায়। এ ওজোনের স্তরটি সূর্যরশ্মির অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করে থাকে।বায়ুমন্ডলের এ স্তরটি না থাকলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির দহনে প্রাণীর দেহ পুড়ে যেত এবং সমস্ত প্রাণীকুল অন্ধ হয়ে যেত। অতিবেগুনি রশ্মি শোষণ করায় এ স্তরের তাপমাত্রা(প্রায় ৭৬° সেলসিয়াস) এর অনেক বেশি। এর ওপরের সরু অংশকে স্ট্রাটোপজ বলে। এটি একটি সন্ধি অঞ্চল।

৪)মেসোস্ফিয়ার

ওজোন স্তরের ঊর্ধ্বের স্তরটিকে মেসোস্ফিয়ার বলা হয়। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৫০ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত এ স্তরটি অবস্থিত। এ স্তরে উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে উষ্ণতা হ্রাস পায়। এই স্তরে বায়ুর চাপ অত্যন্ত ক্ষীণ।এর উর্ধ্বসীমায় বায়ুর তাপমাত্রা প্রায় ৬৫.৫° সেলসিয়াস। এর উর্ধ্বসীমানাকে মেসোপজ বলে। এর ওপর হতে পুনরায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

৫)থার্মোস্ফিয়ার

মেসোপজ হতে ঊর্ধ্বে প্রায় ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তর বিস্তৃত। এখানে বায়ুর উষ্ণতা দ্রুত হারে বৃদ্ধি পায় বলে একে থার্মোস্ফিয়ার বা তাপমন্ডল বলে। মধ্যাহ্নে এ স্তরের উষ্ণতা প্রায় ১০৯০°সেলসিয়াস। এখানে বায়ু খুব হালকা। কার্যত বায়ুশূন্য বলে এখানে তাপের পরিবহন অতি নগণ্য। আয়নাইজেশনের জন্য এ অঞ্চলকে আয়নোস্ফিয়ারও বলা হয়। এখানে আয়নের আধিক্যর ফলে বেতার তরঙ্গগুলো এই স্তরের মধ্যে প্রতিফলিত হয়ে পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসে

৬)এক্সোস্ফিয়ার

থার্মোস্ফিয়ারের ওপরের স্তরটিকে এক্সোস্ফিয়ার বলে। এটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরের স্তর। এ স্তর প্রধানত অক্সিজেন, হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণু দ্বারা গঠিত। এ স্তরের পরই বিষমমন্ডল শুরু হয়।

খ)বিষমমন্ডল

বায়ুমন্ডলের এ অংশে বায়ুর উপাদানগুলোর অনুপাত সমান থাকে না।তাই একে বিষমমন্ডল বলা হয়।বায়ুমন্ডলের এ স্তরটি সমমন্ডলের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ,ভূপৃষ্ঠের ৯০ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব থেকে ১০.০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত আছে বলে ধরা হয়। বিভিন্ন গ্যাসের পরিমাণের তারতম্য অনুসারে এই স্তরটিকে চারটি উপস্তরে ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন:

১) নাইট্রোজেন পারমাণবিক স্তর

ভূপৃষ্ঠের ৯০ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব থেকে ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত এই স্তরটি বিস্তৃত। নাইট্রোজেনের আধিক্য হেতু এর উপস্তরটিকে নাইট্রোজেন পারমাণবিক স্তর বলা হয়।

২) অক্সিজেন পারমাণবিক স্তর

নাইট্রোজেন পারমাণবিক স্তরের উপরে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের ঊর্ধ্বে ২০০ কিলোমিটার থেকে ১১০০ কিলোমিটার ঊর্ধ্ব পর্যন্ত এই স্তরটি বিস্তৃত। অক্সিজেন পারমাণবিক অনুর আধিক্য হেতু এ উপস্তরটিকে অক্সিজেন পারমাণবিক স্তর বলা হয়।

৩) হিলিয়াম স্তর

অক্সিজেন পারমাণবিক স্তরের ঊর্ধ্বে ১১০০ কিলোমিটার থেকে ৩৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত স্তরটি প্রধানত হিলিয়াম গ্যাস দ্বারা গঠিত বলে একে হিলিয়াম স্তর বলা হয়।

৪) হাইড্রোজেন স্তর

হিলিয়াম স্তরের ওপর বায়ুমণ্ডলের সর্বোচ্চ স্তরটি হাইড্রোজেন পরমাণু দ্বারা গঠিত বলে একে হাইড্রোজেন স্তর বলা হয়। এই স্তরটি ৩৫০০ কিলোমিটার থেকে ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বলে অনুমান করা হয়। কারণ এর পরে হাইড্রোজেন পরমাণুর ঘনত্ব অসীম আকাশের পরমাণু সমান হয়ে যায়।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে বায়ুমণ্ডল বহু গ্যাসের সংমিশ্রণ। এতে আরও রয়েছে বহু সংখ্যক কঠিন ও তরল কণিকা, যাদের একত্রে রঞ্জক পদার্থ বলা হয়। আর এই বায়ুমণ্ডলের স্তরগুলো একের পর এক সাজানো রয়েছে। এই স্তরগুলো ক্রমশ উপরের দিকে হালকা এবং উপরের স্তরগুলো নিচের স্তর গুলোর উপর অধিকতর চাপ দিতে থাকায় নিচের স্তর অত্যন্ত ঘন। আজকের আর্টিকেলে বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি ও কি কি, সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url