বায়ুমণ্ডলের উপাদান সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা কর

বায়ুমণ্ডল কি

আমাদের এই পৃথিবী নানা প্রকার গ্যাসীয় উপাদান দ্বারা পরিবেষ্টিত। এইসব গ্যাসীয় উপাদানের সমষ্টিকে সাধারণভাবে বায়ু বলে। সুতরাং যে অদৃশ্য বায়ু বা গ্যাসীয় উপাদানের পুরু আবরণ পৃথিবীকে বেষ্টন করে রয়েছে তাকে বায়ুমণ্ডল বলে। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে এই মন্ডলটি পৃথিবীর গায়ে লেগে রয়েছে এবং এর সাথে আবর্তন করছে।

বিজ্ঞানীগণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে সমমন্ডল ও বিষম মন্ডল নামে দুই ভাগে ভাগ করেছেন। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকায় বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন, বিশেষ করে গ্যাসীয় অনুপাত প্রায় একই রূপে থাকে বলে বায়ুমণ্ডলের এই নিম্নাংশ সমমন্ডল বা হোমোস্ফিয়ার নামে পরিচিত। পক্ষান্তরে, এই স্তরের উপরের অংশে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাতের বিভিন্নতা এবং স্থানভেদে স্তর গুলোর দূরত্ব আলাদা হওয়ায় এটি বিষমমন্ডল বা হেটোরোস্ফিয়ার নামে পরিচিত।

বায়ুমণ্ডলের উপাদান সমূহ বিস্তারিতভাবে আলোচনা কর

বায়ুমন্ডলের উপাদান সমূহ

পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়ে গঠিত হলেও মূলত: নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন প্রায় ৯৯% বায়ু কুণ্ডলী গঠন করেছে। তবে জলীয়বাষ্প ও ধুলিকণার পরিমাণ বাড়লে অন্যান্য গ্যাসীয় পদার্থের সাথে মূল উপাদানেরও পরিবর্তন হতে পারে।

বায়ুমন্ডলের প্রধান গ্যাস সমূহের তালিকা:

 গ্যাসের নাম

 শতকরা হার

 গ্যাসের নাম

 শতকরা হার

 নাইট্রোজেন

 ৭৮.০৩%

 হাইড্রোজেন

 ০.০১%

 অক্সিজেন

 ২০.৯৯%

 নিয়ন

 ০.০০১৮%

 আর্গন

 ০.৯৪%

 হিলিয়াম

 ০.০০০৫%

 কার্বন-ডাই-অক্সাইড

 ০.৯০০৩%

 ক্রিপটন

 ০.০০০১%

 

 

 জেনন

 ০.০০০০০৯%

 

 

 ওজোন

 ০.০০০০০১%

নাইট্রোজেন

বায়ুমণ্ডলের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই গ্যাসটির পরিমাণ প্রায় ৭৮. ৩%। বায়ুমন্ডলে নাইট্রোজেনের অবস্থানের কারণে বায়ুর চাপ, বায়ুপ্রবাহ এবং বজ্র-বিদ্যুতের মত ঘটনাবলী সংঘটিত হয়ে থাকে। গ্যাসটির কোন বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ নেই। নাইট্রোজেন উদ্ভিজে প্রোটিন সরবরাহের ব্যাপারে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে থাকে।এছাড়া আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রও এটি সহায়তা করে।

ভূপৃষ্ঠ থেকে ১২৮ কিলোমিটার উর্ধ্বস্থান পর্যন্ত নাইট্রোজেন অক্সিজেনকে ছাড়িয়ে দিয়ে অগ্নিকাণ্ড নিবারণ করে। এই প্রক্রিয়া না ঘটলে জীবজগৎ ভস্মীভূত হয়ে যেত। নাইট্রোজেন ব্যতিরেকে উদ্ভিদের জন্ম-বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্ভব নয়। উদ্ভিদ নাইট্রোজেনকে যৌগ হিসাবে ব্যবহার করে।

অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন সমন্বয়ে গঠিত যৌগ বৃষ্টির সঙ্গে ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হলে তা' মৃত্তিকার রসায়ন হিসাবে কাজ করে ও উদ্ভিদের দেহে প্রবেশ করে।উদ্ভিদের প্রোটপ্লাজমে নাইট্রোজেন অবস্থান করে এবং নাইট্রোজেনের কারণেই উদ্ভিদের পাতার রং সবুজ দেখায়। নাইট্রোজেনের যৌগসমূহ কৃষি ক্ষেত্রে সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মৎস ক্ষেত্রে প্লাঙ্ককটন সৃষ্টিতে নাইট্রোজেন যৌগ ইউরিয়া ব্যবহৃত হয়।

অক্সিজেন

অক্সিজেনকে জীবনদায়িনি গ্যাস হিসেবে অভিহিত করা যায়। কারণ এটা ছাড়া জীবকূলের টিকে থাকা অসম্ভব। অক্সিজেন জ্বালানিতে বা দহনক্রিয়ায় সহায়তা করে তবে নিজে জ্বলে না। বায়ুমন্ডলে ২০.৮০%- ২১% পর্যন্ত অক্সিজেন রয়েছে এবং উর্ধ্বাকাশে ৬৮ কিলোমিটার পর্যন্ত এর উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়েছে। তবে ১৬ কিলোমিটারের উপরে এর উপস্থিতি অনিয়মিত।

অক্সিজেনের সাথে বিভিন্ন পদার্থের বিক্রিয়া হয় ধীরগতিতে যা'ধীর জারন বা Slow Oxidation নামে পরিচিত। এ প্রক্রিয়ায় কোন আলোর প্রজ্জ্বলন ঘটে না। মরীচা জারন প্রক্রিয়ার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ভূমিরূপের পরিবর্তনেও অক্সিজেনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিলার বিচূর্ণীকরণে জারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিটি জীবন্ত বস্তুর শ্বসন ক্রিয়া এবং দৈহিক তাপ উৎপাদনে অক্সিজেনের উপস্থিতি অপরিহার্য।

শুধু ভূ-পৃষ্ঠস্থ নয়-জলভাগের প্রাণী ও জীবকূলও পানির মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে থাকে। এক কথায় প্রতিটি জীব এবং অনুজীবই অক্সিজেনের উপর নির্ভরশীল। মানব সভ্যতার বিকাশ ও স্থায়িত্ব সম্পূর্ণ অক্সিজেন নির্ভর। দহন ব্যতীত শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন রন্ধন কিংবা কোন উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্ভব নয়।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড

কার্বন-ডাই-অক্সাইড একটি ভারী গ্যাস এবং মূলত: বায়ুমণ্ডলের নীচ স্তরে এটি সীমাবদ্ধ। এটি বায়ুমণ্ডলের অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণে বিদ্যমান এবং উর্ধ্বাকাশে ৩২ কিলোমিটার পর্যন্ত এর উপস্থিতি সনাক্তকৃত। উনিশ শতকের পর থেকে জীবাশ্ম জ্বালানীর ব্যবহার বৃদ্ধিতে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণও তাৎপর্য পূর্ণভাবে বেড়ে গেছে যা' বৈশ্বিক উষ্ণায়নে মূল ভূমিকা পালন করছে।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদের জন্ম ও বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দিনের বেলায় উদ্ভিজ সালোক-সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে খাদ্য তৈরী করে। ঐ উদ্ভিজ আবার প্রাণী জগতের খাদ্য সরবরাহ করে। এভাবে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সমগ্র প্রাণী জগতের টিকে থাকার ক্ষেত্রে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

পৃথিবীর সৃষ্টির প্রথম দিকে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪০%। উদ্ভিজ বিকাশের সাথে সাথে কার্বন-ডাই-অক্সাইড এর পরিমাণ কমতে থাকে। পরবর্তীতে ব্যাপক বন জঙ্গল সৃষ্টি ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে কয়লা ও গ্রাফাইটের উদ্ভব ঘটে। প্রাণী দেহ থেকে সৃষ্টি হয় খনিজ ও গ্যাস।ঐ সব খনিজ ব্যাপক কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণ করে থাকে। ইদানিং জীবাশ্ম জ্বালানি বৃদ্ধিতে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে উত্তাপ বেড়ে যাচ্ছে।

কার্বন-ডাই-অক্সাইড অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপনে সহায়তা করে। পানিতে দ্রবীভূত অবস্থায় এটা পানির দ্রবণ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। চুনাপাথরীয় এলাকায় কার্বন ডাই অক্সাইড থাকায় বৃষ্টির পানির সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তন সাধন করে থাকে।এছাড়া লৌহের অক্সাইড এর সাথে বিক্রিয়ার মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

হাইড্রোজেন

হাইড্রোজেন অত্যন্ত হালকা গ্যাস এবং বায়ুমন্ডলে মাত্র ০.০১% এর মতো স্থান দখল করে আছে। উর্ধ্বাকাশে ১১০ কিলোমিটার পর থেকে এর নিয়মিত উপস্থিতি সনাক্তকৃত হয়েছে। হাইড্রোজেন একটি দাহ্য গ্যাস এবং নিজেই জ্বলে। বর্তমানে হাইড্রোজেন থেকে ভারী পানি ও ব্যাপক ধ্বংস ক্ষমতাসম্পন্ন বোমা তৈরী করা হয়েছে।

ওজোন

ওজোন অক্সিজেনের একটি বিশেষ রূপ। ঊর্ধ্ব বায়ুস্তরে স্বল্প পরিমানে এর অবস্থান। পাতলা ওজোন স্তরের মূল কাজ সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি জীবজগতকে রক্ষা করা। বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস বৃদ্ধিতে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু এলাকার ওজোন স্তরে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে যা' ওজোন হোল নামে পরিচিত।

জলীয় বাষ্প

জলীয় বাষ্প বায়ুমন্ডলের সর্বাধিক পরিবর্তনশীল উপাদান। উষ্ণ ও আর্দ্র ক্রান্তীয় এলাকায় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৪% পর্যন্ত হতে পারে। তবে শুষ্ক এলাকায় এটা ১% এর কম জলীয় বাষ্প সূর্যেও উত্তাপ শোষণ করে। এছাড়া এটা পৃথিবী থেকে বিকীর্ণ উত্তাপও শোষণ করে। এভাবে বাতাসের জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের চাদর হিসাবে কাজ করে ভূ-পৃষ্ঠকে অতিরিক্ত শৈত্য কিংবা উত্তাপ থেকে রক্ষা করে।

জলীয়বাষ্প ঘনীভূত ও সম্পৃক্ত হয়েই পৃথিবীতে বৃষ্টি কিংবা শিলাবৃষ্টি ঘটায় এবং বিভিন্ন ধরনের মেঘগুলো সৃষ্টি করে। জলীয় বাষ্পের পরিমাণ উচ্চতার সাথে সাথে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। বাতাসের জলীয় বাষ্পের ৫০% এরও বেশি থাকে ২০০০ মিটারের নিচে। এছাড়া নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলের দিকেও এটা হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ১০°- ৩০° অক্ষাংশের মধ্যে অধিকাংশ জলীয়বাষ্প সৃষ্টি হয়ে থাকে।

মিহিকণা

বায়ুমণ্ডলের মিহিকণাগুলি বিভিন্ন উৎস থেকে এসে থাকে। মিহি বালু বা ধুলি, ছাই, ধোয়া, কিংবা সামুদ্রিক লবনের কণাগুলি বায়ুতে মিশ্রিত অবস্থায় থাকতে পারে। মিহি কণাগুলির অবস্থান বায়ুমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এগুলি hygroscopic nuclei হিসাবে কাজ করে যার মাধ্যমে জলীয়বাষ্প মিহি কণাগুলিকে আশ্রয় করে বারিপাত সৃষ্টি করে থাকে।

ঐ কারণে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের পর বাতাসে মিহিকণা বৃদ্ধি জনিত কারণে উত্তাপ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের সময় আকাশে দৃষ্টি নন্দন রং মিহিকণা গুলির কারণেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। এছাড়া কুয়াশা ও ধোঁয়াশা সৃষ্টিতেও মিহিকণা গুলি প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে।

মিহিকণাগুলির বায়ুমন্ডলের নিম্নস্তরেই সাধারণত অবস্থান করে। তবে মাঝে মধ্যে উলম্ব বায়ু স্রোত মিহি কণাগুলিকে উর্ধ্বে নিয়ে যায়। নিরক্ষীয় ও মেরু অঞ্চল অপেক্ষা ক্রান্তীয় ও নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের বায়ুতে ধুলিকণার পরিমাণ বেশি। বায়ু প্রবাহের কার্য বেশি থাকাটাই এর কারণ।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url