ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল

প্রিয় পাঠক আপনারা কি ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে জানতে চান? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল

প্রাকৃতিক দুর্যোগ সমূহের মধ্যে ভূমিকম্প অন্যতম। ভূমিকম্প খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে মানুষের জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। বিশ্বের কতগুলো অঞ্চলে ভূমিকম্প সংঘটনের হার খুব বেশি। আবার কতগুলো অঞ্চলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশ ভূমিকম্প নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে বেশ পরিচিত। আজকের আর্টিকেলে ভূমিকম্পের কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

ভূমিকম্প কি

ভূমিকম্প বলতে সাধারণভাবে ভূ-পৃষ্ঠে সৃষ্ট কম্পনকে বোঝায়। অর্থাৎ ভূঅভ্যন্তরে হঠাৎ সৃষ্ট কোন কম্পন যখন ভূত্বককে আকস্মিক আন্দোলিত করে, সাধারণত তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্পের ফলে ভূ-পৃষ্ঠে পরিবর্তন সূচিত হয়। মৃদু ভূমিকম্প আমরা অনুভব করতে পারি না। কিন্তু অপেক্ষাকৃত প্রবল ভূমিকম্প আমরা সহজে অনুভব করতে পারি। সাধারণত ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় এবং পর্যায়ক্রমে একাধিকবার ঘটতে পারে। ভূমিকম্পনের মাত্রা তীব্র হলে ঘরবাড়ি,রাস্তা-ঘাট,গাছপালা প্রভৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

ভূমিকম্পের কেন্দ্র ও উপকেন্দ্র

পৃথিবীর অভ্যন্তরে কোন একটি স্থানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। ভূঅভ্যন্তরের যে স্থানে ভূমিকম্পনের উৎপত্তি হয় তাকে কেন্দ্র (Centre) বলা হয়। কেন্দ্রের সোজা উপরে ভূপৃষ্ঠস্থ বিন্দুকে উপকেন্দ্র (Epicentre) বলে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূ-অভ্যন্তরের প্রায় ১৬ থেকে ২০ কিলোমিটার এর মধ্যে অবস্থিত থাকে।

ভূমিকম্পের কারণ

বৈজ্ঞানিকগণ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহায্যে ভূমিকম্পের নিম্নলিখিত কারণগুলো নির্ণয় করেছেন যেমন:

ভূপাত

কোন কারনে পাহাড়-পর্বত হতে বৃহৎ শিলাখণ্ড ভূত্বকের উপর ধসে পড়লে ভূমিকম্প হয়। সাধারণত ভাঁজ পর্বতের নিকট অধিক ভূমিকম্প হয়। কারণ নবীন ভাঁজ পর্বতের শিলা গুলো পরস্পর দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত না হওয়ায় সহজেই ভূপাত ঘটে এবং ভূমিকম্প হয়।১৯১১ সালে পামীর মালভূমিতে বিশাল ভূপাত হওয়ার ফলে তুরস্কে ব্যাপক ভূমিকম্প হয়েছিল।

শিলাচ্যুতি বা শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টি

কোন কারনে পৃথিবীর অভ্যন্তরে বড় রকমের শিলাচ্যুতি ঘটলে বা শিলাতে ভাঁজের সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। শিলাচ্যুতি ঘটার ফলে ভূত্বকের কোন অংশ উপরে উত্থিত হয় বা নিচে বসে যায়। এ সময় চ্যুতির তলে (Fault plane) প্রবল ঘর্ষণ সৃষ্টি হয়। এই ঘর্ষণের ফলে ভূমিকম্প হয়। ১৯৩৪ সালে বিহারে এবং ১৯৫০ সালে আসামে এ কারণেই ভূমিকম্প হয়েছিল।

তাপ বিকিরণ

ভূত্বক তাপ বিকিরণ করে সংকুচিত হলে ফাটল ও ভাঁজের সৃষ্টি হয়ে ভূমিকম্প হয়। কোন কোন ভূবিজ্ঞানীর মতে পরিচলনের মাধ্যমে উত্তল তরঙ্গের সৃষ্টি করে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ বিকিরণ করে। এ তরঙ্গের প্রভাবেও ভূমিকম্প হয়।

ভূগর্ভস্থ বাষ্প

নানা কারণে ভূগর্ভে বাষ্পের সৃষ্টি হয়। এ বাষ্প ক্রমাগত বৃদ্ধি পেলে তা ভূত্বকের নিম্নভাগে ধাক্কা দেয়, ফলে প্রচন্ড ভূকম্পন অনুভূত হয়। এ বাষ্প ভূপৃষ্ঠের কোন ফাটল বা কোন দুর্বল স্থান দিয়ে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত ভূকম্পন অব্যাহত থাকে।

ভূগর্ভস্থ চাপের হ্রাস

অনেক সময় ভূগর্ভে হঠাৎ চাপের হ্রাস হলে পৃথিবীর মধ্যকার পদার্থ কঠিন অবস্থা হতে তরল অবস্থায় পরিণত হয় এবং নিচে নামতে থাকে। এতেও ভূত্বক কেঁপে ওঠে।

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের সময় তার জ্বালা মুখ দিয়ে প্রবল বেগে বাষ্প লাভা প্রভৃতি বের হতে থাকে এবং এর ফলে ভূমিকম্প হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের ফলে ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে।

ভূপৃষ্ঠের চাপ বৃদ্ধি

ভূপৃষ্ঠের উপর চাপ বৃদ্ধি পেলে তার নিচে শিলাচ্যুতি হয়েও ভূমিকম্প হয়। যেমন, কোন নিম্নস্থানে ক্রমাগত পলি সঞ্চিত হতে থাকলে কালক্রমে ঐ স্থান অত্যাধিক পুরু হয়। ফলে সেখানকার চাপ পূর্বের চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এর কারনে ঐ ভারী শিলাস্তর নিচে নেমে গিয়ে ভূআলোড়নের সৃষ্টি করে এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়।

হিমবাহের প্রভাব

কখনো কখনো প্রকাণ্ড হিমবাহ পর্বতগাত্র হতে হঠাৎ নিচে পতিত হয়। এতে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে এবং ভূমিকম্প হয়।

ভূঅভ্যন্তরে ভূপৃষ্ঠস্থ জলের প্রবেশ

ভূপৃষ্ঠস্থ পানি কোন প্রকারে পৃথিবীর উত্তপ্ত অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে বাষ্পে পরিণত হয়। এ বাষ্পের পরিমাণ বেশি হলে তা ভূত্বকের নিচে ধাক্কা দিয়ে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করে।

মনুষ্য সৃষ্ট ভূমিকম্প

বর্তমান যুগের সম্পদ সৃষ্টি ও তার সুষ্ঠ ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের ফলে অনেক সময় মনুষ্য সৃষ্ট কারণে ভূমিকম্প হচ্ছে। যেমন: ১৯৬৭ সালে মহারাষ্ট্রের কয়না নগরের ভূমিকম্পের জন্য দায়ী কয়না নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের ফলে গঠিত কয়না নদীর পানি রাশি নিম্নে অবস্থিত শিলা স্তরের উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে, এর ফলে শিলা স্তর স্থানচ্যুত হয়ে ভূমিকম্প ঘটায়। খনি থেকে খনিজ পদার্থ তোলার সময় বা পরে যে কোন সময় ভূমিকম্প হতে পারে।

ভূমিকম্পের ফলাফল

ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি

ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকে অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি হয়। ফাটল সৃষ্টি হলে কখনও কখনও তার মধ্য দিয়ে কাদা,উষ্ণ পানি,বালি প্রভৃতি বের হয়। চ্যুতির সৃষ্টি হলে তার মধ্যবর্তী ভূভাগ বসে যাওয়ায় স্রস্ত উপত্যকা(Rift valley) এবং উঠে যাওয়ায় হর্স্ট (Horst) বা স্তূপ পর্বতের সৃষ্টি হয়।

সমুদ্রতলের পরিবর্তন

ভূমিকম্পের ফলে কখনো কখনো সমুদ্র তলের অনেক স্থান উপরে উত্থিত হয়। আবার স্থলভাগের অনেক স্থান সমুদ্রতলে ডুবে যায়।১৯২১ সালের ভূমিকম্পের ফলে টোকিও উপসাগরের তলদেশ ৬০০ মিটার উঁচু হয়। ১৮৯৯ সালে ভূমিকম্পে ভারতের কচ্ছ উপসাগরের উপকূলে প্রায় ৫ হাজার বর্গকিলোমিটার স্থান সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয়। ভূমিকম্পের ফলেই সমুদ্রগর্ভ হতে হিমালয় পর্বত উত্থিত হয়েছে।

নদীর গতিপথ পরিবর্তন

নদীর গতির ওপর ভূমিকম্পের প্রভাব ব্যাপক রয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে মাটি,বালি প্রভৃতি জমা হয়ে নদীর গতি পরিবর্তন বা বন্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে নদী শুকিয়ে যায় অথবা শুষ্ক ভূমিতে জলাভূমির সৃষ্টি হয়। ১৯৫০ সালে আসামের ভূমিকম্পে দিবং নদীর গতি পরিবর্তিত হয়।অনেক সময় ভূমিকম্পের ফলে পার্বত্য অঞ্চল হতে ধস নেমে নদীর গতিরোধ করে হদের সৃষ্টি করে।

ভাঁজের সৃষ্টি

ভূমিকম্পের প্রভাবে অনেক সময় ভূপৃষ্ঠে ভাঁজের সৃষ্টি হয়। এ ভাঁজ সাধারণত বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী হয় না। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের ভাঁজের সৃষ্টি হতে দেখা গেছে।

ভূমির উত্থান ও অবনমন

ভূমিকম্পের ফলে ভূমির উত্থান ও অবনমন হয়। যেমন, কখনো কখনো উচ্চ ভূমি সমুদ্রের পানিতে নিমজ্জিত হয় আবার সমভূমি অঞ্চল বসে গিয়ে তথায় পানি জমে হ্রদের সৃষ্টি হয়। আবার সমুদ্র তলদেশের কোন স্থান উঁচু হয়ে সমুদ্রের মধ্যে দ্বীপের সৃষ্টি হয়।

হিমানী সম্প্রপাত

ভূমিকম্পের ফলে পর্বতগাত্র হতে বৃহৎ বৃহৎ বরফের খন্ডগুলো নিচে পতিত হয়ে হিমানী সম্প্রপাতের সৃষ্টি করে। ভূমিকম্পের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল হিমানী সম্প্রপাত হতে দেখা গেছে।

ভূপাত

ভূমিকম্পের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে বিশাল শিলাখন্ড হঠাৎ নিচের পতিত হয় এবং পর্বতের পাদদেশের ব্যাপক ক্ষতি করে। ভূপাতের কারণে যান মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়।

বন্যার সৃষ্টি

কোন কোন ক্ষেত্রে ভূমিকম্পের ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়। ভূমিকম্পের প্রভাবে সমুদ্রের পানি তীর হতে নিচে নেমে যায় এবং পরক্ষণেই ভীষণ গর্জন করে ১৫ থেকে ২০ মিটার উঁচু হয়ে ঢেউয়ের আকারে উপকূলে এসে বন্যার সৃষ্টি করে। ১৯৫২ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের কিউরাইল দ্বীপপুঞ্জের নিকট সমুদ্র-কম্পে সৃষ্ট ৪০ মিনিট স্থায়ী ভয়ঙ্কর সুনামি কামচাটকা ও কিউরাইল উপকূলে ভীষণ গর্জন করে প্রচন্ড আঘাত হানে। ফলে সেখানকার জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

সুনামি প্রবাহ

সমুদ্রের তলদেশে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রচন্ড ও ধ্বংসাত্মক বিশাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এরূপ বিশাল সামুদ্রিক ঢেউ গুলোকে সুনামি বলা হয়। এর ফলে উপকূলবর্তী সমুদ্রের অঞ্চলের জান মালের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

ধ্বংসলীলা

ভূমিকম্প মানুষের কাছে বিভীষিকার মত। ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রের সন্নিহিত অঞ্চলের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। ধ্বংস স্তুপের তলায় চাপা পড়ে অগণিত গৃহপালিত পশু ও মানুষ মৃত্যু পথের পতিত হয়। তড়িৎ বর্তক্ষেপ (Short circuit) পাইপ ভেঙ্গে দাহ্য গ্যাসের নির্গমনের ফলে শহর ও জনপদে আগুন ধরে যায়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধ্বংস স্তুপের চাপা পড়ার থেকে আগুনে পুড়ে বেশি লোক মারা যায়। সমুদ্র উপকূলবর্তী জলোচ্ছ্বাসের ফলেও বহু স্থানে অগণিত লোক হতাহত হয়। ধস নামার দরুন এবং ভূমিতে ফাটল সৃষ্টি হয়ে রাস্তাঘাট অকেজো হয়ে পড়ে। সংকোচনের ফলে রেলপথ বেঁকে যায়, সেতুর ক্ষতিসাধন হয়, ভূগর্ভস্থ পানির পাইপ, বৈদ্যুতিক ও টেলি গ্রাফ কেবল ভেঙ্গে যায়।

শেষ কথা:

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগই হঠাৎ করে আসে। আর এই দুর্যোগকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের নেই। তাই এর হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সচেতন থাকা এবং বাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরীর সময় নিয়ম মেনে চলা। বাড়ি তৈরির সময় খরচ বাঁচানোর চেষ্টা করলে তা আপনার বাড়িটি কে দুর্বল করবে। বলা যায় না,এই ফাঁকি হয়তো আপনার জীবনের বিনিময়ে শুধতে হবে। তাই সকলের এ বিষয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা উচিত।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url