জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি বর্ণনা কর

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি জানতে চান? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ আজকের আর্টিকেলে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি বর্ণনা কর

জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদান আবার কতিপয় নিয়ামক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ামক গুলো ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। আজকের আর্টিকেলটি পড়লে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইল।

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ

পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকমের জলবায়ু দেখা যায়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর মৌলিক উপাদানই এ বিভিন্নতার কারণ। এ সকল উপাদান আবার কতিপয় নিয়ামক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিয়ামক গুলো ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন স্থানে জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। নিম্নে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ সংক্ষিপ্ত আকারে বর্ণনা দেয়া হলো:

অক্ষাংশ

লম্বভাবে পতিত রশ্মি স্বল্প স্থানে তীব্র তাপ দেয়। পক্ষান্তরে তির্যক রশ্মি অধিক স্থান জুড়ে এবং অধিক বায়ুস্তর ভেদ করে আসে বলে উত্তাপ কম। নিরক্ষরেখার উপর সূর্য সারা বছর লম্বভাবে কিরণ দেয় এবং দিবা-রাত্রি প্রায় সমান বলে সেখানে উত্তাপ বেশি।

নিরক্ষরেখা হতে যত উত্তর বা দক্ষিণে যাওয়া যায় সূর্যরশ্মি ততই তির্যকভাবে পতিত হয় এবং দিবা-রাত্রির পার্থক্যও বৃদ্ধি পায়। ফলে তাপমাত্রা কমতে থাকে। প্রতি ১ ডিগ্রি অক্ষাংশে অন্তর দূরত্বে-১৭,২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস পায়।

উচ্চতা

সমুদ্র সমতল হতে যতই উপরে ওঠা যায় তাপমাত্রা ততই কমতে থাকে। প্রতি ১০০মিটার উচ্চতায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হ্রাস পায়। নিচের বায়ুস্তরে ধূলিকণা, জলীয়বাষ্প ইত্যাদি বেশি থাকে। এগুলো ভূপৃষ্ঠ হতে বিকীর্ণ তাপের প্রধান শোষক।এ কারণে একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতায় দুটি স্থানের তাপমাত্রা পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

যেমন: দিনাজপুর অপেক্ষা শিলং এর তাপমাত্রা অনেক কম। আবার দেখা যায় কলকাতা অপেক্ষা শিলিগুড়ি এবং শিলিগুড়ি অপেক্ষা দার্জিলিং অধিক শীতলতর। এই কারণে আফ্রিকার কিলিমানজারো পর্বত নিরক্ষরেখায় অবস্থিত হলেও সেখানে তাপ সর্বদা হিমাঙ্কের নিচে থাকে।

জলীয়বাষ্প

জলীয় বাষ্পের তাপ শোষণ ও সংরক্ষণের ক্ষমতা বেশি। তাই একই অক্ষাংশে অবস্থিত স্থান সমূহের বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পার্থক্য হেতু তাপমাত্রারও পার্থক্য হয়। কোন স্থানের বায়ুতে অধিক জলীয়বাষ্প থাকলে সে স্থানে বায়ুর তাপ বেশি প্রখর হতে পারে না এবং বেশী কমও হতে পারে না। কারণ জলীয়বাষ্প সূর্যের তাপ অনেকটা শোষণ করে নেয়।

জলীয়বাষ্প সূর্যের খানিকটা তাপ শোষণ করে উষ্ণ হয় বলে রাত্রিতে শীতও বেশি হতে পারে না। সমুদ্রের নিকটবর্তী স্থানের বায়ুতে বেশি জলীয় বাষ্প থাকে বলে সেখানে দিনরাত্রির তাপের পার্থক্য খুব কমই হয়। আবার সমুদ্রের উপকূল হতে মহাদেশের অভ্যন্তরে ক্রমশ জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কম হওয়ায় দিনরাত্রির তাপের পার্থক্য ক্রমশ বৃদ্ধি পায়।

সমুদ্রস্রোত

কোন কোন অঞ্চলের বায়ুর তাপ সমুদ্র স্রোতের উপর নির্ভরশীল। যেসব দেশের নিকট দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয় সে সব দেশের উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শীতল সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হলে জলবায়ু অপেক্ষাকৃত শীতল হয়। লন্ডন নিউইয়র্ক হতে উত্তরে অবস্থিত হলেও উষ্ণ সমুদ্র স্রোতের প্রভাবে এটা নিউইয়র্ক হতে অধিক উষ্ণ থাকে। অথচ শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম উপকূল শীতল থাকে।

সমুদ্র থেকে দূরত্ব

জলভাগের অবস্থান কোন স্থানের আবহাওয়া ও জলবায়ুকে মৃদু ভাবাপন্ন করে। সমুদ্র উপকূলে দিবা-রাত্রির তাপমাত্রার ব্যবধান কম হয়। কিন্তু সমুদ্র হতে দূরে মহাদেশের অভ্যন্তরে শীত গ্রীষ্ম উভয়ই চরম হয়ে থাকে।

বায়ুমন্ডলের গভীরতা

বায়ুমন্ডলের গভীরতা বেশি হলে তাতে ধূলিকণা ও জলীয়বাষ্প অধিক থাকে। ধূলিকণা ও জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু অধিক ঘন এবং অধিক তাপ গ্রহণ ও সংরক্ষণ করতে পারে। ভূপৃষ্ঠের সর্বত্র বায়ুমন্ডলের গভীরতা সমান নয় বলে তাপের তারতম্য হয়।

বায়ুপ্রবাহ

বায়ুপ্রবাহ জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রিত করে। সমুদ্রের উপর দিয়ে আগত জলীয়বাষ্প পূর্ণ বায়ু কোন অঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে সেখানে বৃষ্টিপাত ঘটায়। শীতল বায়ু উষ্ণ এলাকার উপর দিয়ে এবং উষ্ণ বায়ু শীতল এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে তাপমাত্রা যথাক্রমে কমে ও বাড়ে।

বৃষ্টিপাত

বৃষ্টিপাত জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে।কোন স্থানে বৃষ্টিপাত বেশি হলে সে স্থানের তাপমাত্রা কমে। বৃষ্টিপাতের জন্য বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল অপেক্ষা বর্ষাকাল শীতল থাকে। বৃষ্টি হীনতার কারণে মরু অঞ্চল অধিকতর উষ্ণ।

পাহাড় পর্বতের অবস্থান

বাতাসের গতি পথের সামনে যদি পাহাড় পর্বত লম্বভাবে অবস্থান করে তাহলে জলীয়বাষ্পপূর্ণ বায়ু বাধা প্রাপ্ত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। কিন্তু পাহাড়-পর্বত না থাকলে বা বায়ু প্রবাহের সাথে সমান্তরালে অবস্থিত হলে বৃষ্টিপাত হয় না।পার্বত্য ভূমি অনেক সময় কোন কোন অঞ্চলকে শীতল বায়ু হতে রক্ষা করে আবার উষ্ণও করে।

উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি হিমালয় পর্বত বিশাল প্রাচীরের ন্যায় দন্ডায়মান থেকে ভারত ও বাংলাদেশকে মধ্য এশিয়া হতে আগত শীতকালীন তীব্র শীতল বায়ুর কবল হতে রক্ষা করছে।

জল ও স্থলভাগের প্রভাব

দিবাভাগে সূর্য রশ্মি সমভাবে জল ও স্থলভাগের উপর পতিত হলেও একই সময়ের মধ্যে জল অপেক্ষা স্থল অধিক তাপ গ্রহণ করে। পক্ষান্তরে,রাত্রিতে জল অপেক্ষা স্থলভাগ অধিক তাপ বিকিরণ করে। সে কারণে সূর্যের কিরণে একই সময়ের মধ্যে জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ দ্রুত উত্তপ্ত হয় এবং সৌরতাপের অভাবে জলভাগ অপেক্ষা স্থলভাগ তাড়াতাড়ি শীতল হয়। জলভাগ অপেক্ষায় স্থলভাগ প্রায় ৪.৫ গুন দ্রুত উত্তপ্ত বা শীতল হয়।

ভূমির ঢাল

ভূমি সূর্যের দিকে ঢালু হলে সূর্যকিরণ লম্বভাবে পতিত হয়।ফলে সেই স্থান অধিক উত্তপ্ত হয়। সূর্যের বিপরীত দিকে ঢালু ভূমিতে সূর্যরশ্মি হেলে পড়ে বলে উত্তাপ কম হয়। এজন্য দেখা যায় উত্তর গোলার্ধে সূর্য গ্রীষ্মকালে দক্ষিণমুখী ঢালে অপেক্ষাকৃত লম্বভাবে ও উত্তরমুখী ঢালে অধিক হেলে অবস্থান করে। ফলে উত্তরমুখী ডাল অপেক্ষা দক্ষিণ মুখী ঢাল অধিক সৌরতাপ পেয়ে থাকে।

মৃত্তিকা

প্রস্তর বা বালুকাময় মৃত্তিকা দ্রুত উত্তপ্ত ও শীতল হয়। কিন্তু পলিময় ও আর্দ্র মৃত্তিকার তাপ সংরক্ষণ ক্ষমতা অধিক বলে উষ্ণ বা শীতল হতে অধিক সময় লাগে।

মেঘাচ্ছন্নতা

কোন অঞ্চলের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে মেঘাচ্ছন্নতা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। মেঘের আবরণ যখন কোন অঞ্চলকে ঢেকে রাখে তখন সেখানে দিনের বেলায় সূর্য রশ্মি ভূপৃষ্ঠে পৌঁছতে পারেনা, তেমনি রাত্রিকালে ভূপৃষ্ঠের তাপ বৃহৎ তরঙ্গরুপে বিকিরিত হয়ে মহাশূন্যে বিলীন হতে পারেনা।

মেঘাচ্ছন্নতার ফলে তাই দিনের বেলায় উত্তাপ কম হয়, কিন্তু রাত্রিবেলায় উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। এই কারণে মেঘাচ্ছন্ন রাত্রি মেঘমুক্ত রাত্রির অপেক্ষা বেশি উষ্ণ হয়ে থাকে। একই কারণে নিরক্ষীয় অঞ্চলের রাত্রির উষ্ণতা মরুভূমির রাত্রির উষ্ণতার চেয়ে বেশি হয়।

বনভূমির অবস্থান

বনভূমি অঞ্চলের মৃত্তিকা আর্দ্র থাকে। এছাড়া বনভূমি অঞ্চলে বাষ্পীভবনের সাহায্যে বায়ু অধিক জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। এ জলীয়বাষ্প ঘনীয়ভূত হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। অর্থাৎ বনভূমি অঞ্চলে অধিক বৃষ্টিপাত হয় বলে তাপ কমে যায়। এ কারণে অরণ্যভূমির প্রভাবেও ভূপৃষ্ঠের উপর তাপের তারতম্য ঘটে থাকে।এ কারণে বনভূমি অঞ্চল বনহীন অঞ্চল অপেক্ষা শীতল থাকে।

দিবাভাগের দৈর্ঘ্য

দিন বড় হলে ভূ-পৃষ্ঠে অধিক সময় পর্যন্ত তাপ গ্রহণ করতে পারে এবং অধিক উত্তপ্ত হয়। কিন্তু দিনের তুলনায় রাত্রি বড় হলে তার বিপরীত অবস্থা ঘটে। এ কারণে আমাদের দেশে শীতকাল অপেক্ষা গ্রীষ্মকালে বায়ু অধিক উত্তপ্ত হয়। পৃথিবীর সর্বত্র দিনরাত্রি সমান নয় বলে ভূপৃষ্ঠের উপর বায়ুর তাপের তারতম্য হয়।

শেষকথা:

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ অতিগুরুত্বপূর্ণ।উপরক্ত জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ ছাড়াও কতিপয় উপাদান ও নিয়ামক রয়েছে। জলবায়ুর বিভিন্ন উপাদান ও নিয়ামক এর কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের তাপমাত্রার তারতম্যতা দেখা যায়। আজকের আর্টিকেলে জলবায়ু নিয়ন্ত্রণকারী নিয়ামকসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url