জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

প্রিয় পাঠক আপনারা কি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চান? তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কারণ জলবায়ু পরিবর্তন এমন একটি বিষয় যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। আজকের আর্টিকেলটি পড়লে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে জানতে পারবেন। তাই আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ার অনুরোধ রইলো।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষি,স্বাস্থ্য,শিক্ষা,পরিবেশ,প্রাকৃতিক সম্পদ,অবকাঠামো এবং সর্বোপরি আমাদের জীবন জীবিকার উপর প্রভাব বিস্তার করে। আজকের আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা জানতে পারবেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে।

ভূমিকা

বিজ্ঞানীদের মতে, বহুকাল আগে থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন ঘটে চলেছে। পৃথিবীর সকল শক্তির মূলে রয়েছে সূর্যের আলো ও তাপ যা পৃথিবীর সকল প্রাণীর জীবন ধারণের ক্ষেত্রে সাহায্য করে। পৃথিবীতে প্রতিদিন যে সূর্যকিরণ পৌঁছায়,ভূপৃষ্ঠ তা শোষণ করে। শোষিত সূর্যকিরণ আবার মহাশূন্যে বিকিরিত বা প্রতিফলিত হয়। এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম।

প্রাকৃতিক নিয়মের এই শোষণ- বিকিরণ প্রক্রিয়ায় কোন ধরনের বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলেই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। জলবায়ুর পরিবর্তন এমন একটি বিষয় যা সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকান্ডকে প্রভাবিত করতে পারে। কৃষি,স্বাস্থ্য,শিক্ষা,পরিবেশ,প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো এবং সর্বোপরি আমাদের জীবন জীবিকার জন্য প্রয়োজনীয় যাবতীয় অবলম্বনের সব ক্ষেত্রেই জলবায়ুর সরাসরি প্রভাব রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

ক) কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব অধিক। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের সময় ও পরিমাণে তারতম্য ঘটছে এবং এর প্রভাব পড়ছে ফসলের উৎপাদনশীলতার ওপর। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব দেশের ঝুঁকি বাড়বে তার মধ্যে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য। এর প্রতিক্রিয়ায় এখানে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় বাড়বে। সাগরের উচ্চতা বাড়বে। এতে লাখো মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি:

  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শস্যের গুনাগুন ও উৎপাদনের পরিমাণে পরিবর্তন আসবে। বর্তমান চাষ এলাকায় উৎপাদন হ্রাস পাবে।
  • ফসলে নতুন নতুন রোগবালাই দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে কৃষিতে কীটনাশক ও সারের প্রয়োগ বাড়াতে হবে।
  • সেচের ব্যাপকতা,ভূমিক্ষয়,শস্য বৈচিত্র্য কমে যাওয়া, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার বাড়বে যা পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
  • ২১ শতকে সার্বিকভাবে কৃষির উৎপাদন শতকরা ৩০ ভাগ কমে যেতে পারে।
  • জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পানির স্বল্পতা ঘটবে ও মাটির উর্বরতা কমে যাবে।
  • কৃষিক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর ফলে দারিদ্র্য বাড়বে এবং সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।
  • কিছু অঞ্চলে মৎস্য সম্পদ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে।
  • ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ধান ও গমের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।

খ) স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বিশ্বের জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে এবং ঋতু পরিবর্তনের ফলে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগের জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হচ্ছে। গত শতাব্দীতে এই পরিবর্তন হয়েছে খুব দ্রুত যা ক্রমেই মানব সভ্যতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যেকোনো অঞ্চলের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত থাকে মানুষ। হঠাৎ ঐ আবহাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তনে মানুষ ঘন ঘন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের সুস্থতায় যে হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে, তা আগামীতে আরও তীব্র আকার ধারণ করতে পারে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্ববাসী এখন সোচ্চার। উন্নত বিশ্বের শিল্পায়ন প্রসূত নির্গত গ্যাস বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি করছে। ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে বাড়ছে উষ্ণতা,সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা,এর সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

এই জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হচ্ছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর অধিক হারে কার্বন গ্যাস নির্গমন। এই কার্বন জলবায়ুর সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে দুই জলবায়ুর সঙ্গে মিশে যাওয়ার কারণে বাড়ছে তাপমাত্রা। ফলে অস্বাভাবিকভাবে দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে।আর এভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে।

স্বাস্থ্য সমস্যা

জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন রোগ হচ্ছে যেমন: ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, ডায়রিয়া, অপুষ্টি, পানিবাহিত রোগ, ফুসফুস ও শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ, মানসিক ও সামাজিক সমস্যা প্রভৃতি।

স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব

আইপিসিসির মতে, ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের মধ্যে ভারতকে ১৮ টি তাপপ্রবাহ আঘাত করেছে। এতে মৃত্যু হয়েছে কয়েক হাজার লোকের। বেশি মৃত্যু হয়েছে গ্রামের লোকদের,বৃদ্ধ ও বাইরে থাকা মানুষ বেশি প্রভাবিত হয়েছে এ বিপর্যয়ে। ২০০৬ সালের বানের কারণে রোগ বেড়েছে বাংলাদেশ ও ভারতে। ২০০৭ সালেও বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে হয়েছে প্রবল বন্যা।

২০০৭ সালে ১৫ নভেম্বরে ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত এনেছে বাংলাদেশে। বাতাস প্রবাহিত হয়েছে ঘন্টায় ২৪০-৩২০ কিলোমিটার বেগে হয়েছে প্রবল বৃষ্টি। ৮৫ লাখ মানুষ হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত,মৃত্যুবরণ করেছে ৩ হাজার ৩ শত এর বেশি লোক। আবহাওয়ার কারণে,বিশেষ করে উত্তপ্ত ভূমন্ডলের জন্য বাড়ছে অনেক রোগ। যেমন: অপুষ্টি (বিশ্বজুড়ে প্রতি বছর ৩৭ লাখ মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে)।

ডায়রিয়ায় ১৯ লাখ মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। ম্যালেরিয়ায় প্রাণ হারাতে পারে প্রায় নয় লাখ মানুষ। বাড়ছে শ্বাসযন্ত্রের ব্যাধি, যেমন: হাঁপানি। তাপ প্রবাহের জন্য অনেক লোক হবে তাপাহত। সুপেয় পানির অভাবে বাড়বে পানিবাহিত রোগ কলেরা ও অন্যান্য ডায়রিয়াজনিত বালাই। বাড়বে অপুষ্টি কমে যাবে খাদ্য উৎপাদন ও স্বরবরাহ।

আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর কারণে অনেকে প্রাণ হারাবে, অনেকে হবে আহত ও পঙ্গু। ভেক্টর বাহিত রোগ,যেমন: ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়বে। বাংলাদেশ সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হওয়ার জন্য ভবিষ্যতে অনেক মানুষ হবে গৃহহারা ও স্থানান্তরিত। এমনটি ঘটবে মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়ায়। বাংলাদেশের সিডরের কারণে নয়টি জেলায় যে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সেখানে ডায়রিয়া,চর্মরোগ,চোখের সংক্রমণ,নিউমোনিয়া,টাইফয়েডের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিষয়টি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্পষ্ট করে জানতে হবে যে দ্রুত পরিবর্তনশীল এ পরিবেশে শুধু পশু পাখি ও গাছপালা রক্ষা করা দরকার তাই নয়,সুরক্ষা চাই মানুষের জন্যও। আর চিরাচরিত জনস্বাস্থ্য রক্ষার কৌশল গুলো দিয়েই একে মোকাবেলা করা সম্ভব।

বিশুদ্ধ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের সুব্যবস্থা, নিরাপদ ও পর্যাপ্ত খাদ্য, টিকাদান কর্মসূচি, রোগের তদারকি, নজরদারি ও ব্যবস্থা গ্রহণ, ভেক্টর নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ, দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুতি-এগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে স্বাস্থ্যের উপর যে প্রভাব ফেলবে তা মোকাবেলা করায় মূল কৌশল। এজন্য দেশের সরকার জলবায়ু পরিবর্তন নীতির কেন্দ্রে রাখবে জনগণের সুস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য রক্ষা।

বিভিন্ন রোগব্যাধি ও সমস্যা

১) ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ ব্যাধি: মানুষের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয় বা মানুষের সামান্য উপকার করে থাকে এমন ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে পরিবর্তন হতে পারে।পরিবর্তিত বৈশিষ্ট্যর ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া মানুষের অনেক ক্ষতির কারণ হতে পারে।
কোন কোন ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া দানব আকারে আবির্ভূত হতে পারে। কাজেই এগুলো যাতে অস্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সবার একসাথে ভূমিকা রাখতে হবে।
২) পুষ্টিহীনতা ও শারীরিক সমস্যা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ার ফলে দরিদ্র জনগণ পর্যাপ্ত ও সুষম খাবারের অভাবে পুষ্টির সমস্যায় পড়বে এবং অপুষ্টিজনিত রোগ বেশি হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ত্বক,ফুসফুস,পাকস্থলি,কিডনি,হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-পতঙ্গ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যাচ্ছে।যেসব রোগী দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জটিল রোগে ভোগেন।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি জনিত কারণে যেসব রোগ থেকে নিরাময়েও সমস্যা হবে। বিশেষ করে উষ্ণতা বৃদ্ধিতে ছোট ছোট শিশুর টনসিলের প্রদাহ, কানের সমস্যা, ঘন ঘন সর্দি কাশি,রোটা ভাইরাসের কারণে মারাত্মক ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এতে শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।

৩) অতিরিক্ত গরমে স্বাস্থ্যের সমস্যা: অতিরিক্ত গরম আর সেই সঙ্গে বাতাসে অস্বাভাবিক আর্দ্রতা বাড়ার ফলে স্বাস্থ্য সমস্যায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। হিট এক্সাসন, এমনকি হিট স্ট্রোকের মত মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে।

৪) গর্ভবতী মায়েদের সমস্যা: স্বাভাবিক অবস্থায়ও গর্ভবতী মায়েদের নানা রকম সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি,বায়ু দূষণসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট নতুন পরিস্থিতিতে মা ও নবজাতকের বিভিন্ন জটিলতা বহুগুণ বেড়ে যায়।

বিকলাঙ্গ হাওয়া, গর্ভাবস্থায় শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াসহ নবজাতকের নানা রকম সমস্যা বাড়ছে। জন্মগত ত্রুটি, মস্তিষ্কের বিভিন্ন রোগ, হাবাগোবা শিশুর জন্ম হার বেড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়।

৫) মানসিক ও সামাজিক সমস্যা: উষ্ণপ্রবাহ, শৈতপ্রবাহ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, খরা ইত্যাদি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ঘটনা। দুর্যোগের বিপর্যস্ত পরিবারের জীবন জীবিকা হারানোর মানসিক যন্ত্রণা মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ভয়ংকর প্রভাব ফেলে।

বিপর্যয় পরবর্তীতে অনেকেই মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে থাকেন। এই চাপ বা পীড়াদায়ক পরিস্থিতিতে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার পাশাপাশি সামাজিক উৎপাদনশীলতা ও সৃষ্টিশীলতাও কমিয়ে ফেলে।

গ) জীববৈচিত্র্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জীববৈচিত্র্যের উপর প্রভাব পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কিছু প্রজাতি বিলুপ্ত হতে চলেছে অন্যদিকে এমন অনেক প্রজাতি দেখা যাচ্ছে যা পরিবেশ বান্ধব তো নয়ই বরং মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে জীববৈচিত্র্যের উপর কি ধরনের প্রভাব পড়ে তা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো-

অমেরুদন্ডী প্রাণী এবং কীটপতঙ্গ:

১) বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের ( যেমন: পঙ্গপাল, মাজরা পোকা, পামরি পোকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির পতঙ্গ) বংশ বিস্তার বৃদ্ধি পাবে। ফলশ্রুতিতে কৃষি বিপর্যয় নেমে আসবে।

২) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার বংশ বিস্তার প্রক্রিয়া আরো জোরালো হতে পারে।

সরীসৃপ এবং উভচর প্রাণী:

১) শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ কমে জলাশয় শুকিয়ে গেলে উভচর প্রাণীর বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
২) সামুদ্রিক কচ্ছপের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, নির্ধারিত তাপমাত্রা চেয়ে ১/২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি থাকলে স্ত্রী কচ্ছপের সংখ্যা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা ৩/৪ ডিগ্রি সে. বাড়লে জন্ম নেওয়া সকল কচ্ছপই স্ত্রী হয়ে যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের ধারণা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অতি প্রাচীন নিরীহ সামুদ্রিক কচ্ছপসমূহ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
৩) তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ঘড়িয়াল, কুমিরের ক্ষেত্রে পুরুষ বাচ্চা জন্মগ্রহণ করার প্রবণতা বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে ঘড়িয়াল ও কুমির দ্রুত বিলুপ্ত হতে পারে।
৪) মোটকথা পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে এরা বিলুপ্ত হবে।

মৎস্য সম্পদ

১) মৎস্যকূলের আবাসস্থল ধ্বংস হবে।
২) তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মাছের বিপাকের হার বৃদ্ধি পাবে।
৩) মাত্রারিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে মাছের জীবন চক্র ব্যাহত হবে।
৪) মাছের প্রজনন মৌসুমে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত কিংবা তাপমাত্রা বজায় না থাকলে মাছের প্রজনন ব্যাহত হবে।
৫) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

স্তন্যপায়ী প্রাণী:

১) তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে কোন কোন ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী নির্দিষ্ট সময়ের আগেই শীত নিদ্রা হবে, ফলে তাদের প্রজনন প্রক্রিয়া শুরু হবে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে। আর্কটিক সাগরে বরফ গলে যাওয়ায় মেরু ভাল্লুকের বংশবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।
২) জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গ্রীষ্মকালে সাগরে বরফ গলে গেলে সীলদের জীবন চক্র ব্যাহত হবে।
৩) বঙ্গোপসাগরের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে যদি সুন্দরবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, তবে হরিণ বাঘসহ এখানকার সকল উদ্ভিদ-প্রাণী ক্রমে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।

প্রবাল:

১) তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের ঘনত্ব বৃদ্ধি অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রবালের অন্তত চার ভাবে ক্ষতি হবে যথা:
প্রথমত: প্রবাল এর বর্ণ বিবর্ণ হবে,
দ্বিতীয়ত: প্রবাল প্রাচীরে রোগ দেখা দিবে,
তৃতীয়ত: সামুদ্রিক পানির অম্লতা বৃদ্ধি পেলে প্রবাল মারা যাবে,
চতুর্থত: প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধির ফলে প্রবাল বেশি পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দ্রুত ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যেতে পারে।

পাখি:

১) জলবায়ু পরিবর্তন পাখিদের জৈবিক ঘড়ির কার্যকারিতা নষ্ট করে দিয়ে তাদের ভুল সংকেত দিবে। ফলে পাখিদের পরিযানের সময় হেরফের হয়ে যাবে এবং তারা আরো প্রতিকূল অবস্থার শিকার হবে।
২) ২°সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পাখিদের বিলুপ্তির হার অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
৩) সাধারণভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পাখিদের আবাস নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে তাদের বিলুপ্তির সূচনা হতে পারে।

ঘ) প্রাকৃতিক সম্পদের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

রুপ-রস গন্ধে ভরা এই পৃথিবীটা মানুষের একার জন্য নয়। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে হাজারো রকমের প্রাণী,কীটপতঙ্গ,অসংখ্য প্রকারের উদ্ভিদ,বৃক্ষরাজি,নানা রঙের ফুল ও পাখি মিলিয়ে পৃথিবীতে প্রাণের যে মেলা সরলার্থে তাই জীববৈচিত্র্য। সকল প্রাণীর ও উদ্ভিদের সুষম সহাবস্থানই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে রেখেছে।

এই জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব রক্ষায় অপরিহার্যরূপে অস্তিত্বমান পরিবেশ ও প্রতিবেশ পাহাড়,নদী,ঝর্ণা সাগর,আকাশ,বাতাস,চন্দ্র,সূর্য,তারা। সকল প্রাণীর উচ্চারণমালা,পাখির মধুর কল-কাকলি, উদ্ভিদের সবুজ অভিব্যক্তি,পাহাড়ের ঝর্ণা,নদীর কুলু-কুলু ধ্বনি এসব কিছু নিয়েই লক্ষ যুগের সংগীত মাখা সুন্দর এই বসুন্ধরা।

পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভারসাম্যপূর্ণ জীববৈচিত্র্যের উপর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। আর প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসের সার্বিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদেরকে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ক্রমবর্ধমান উষ্ণায়ন পর্বতমালার তুষার, হিমবাহের বরফ ও মেরু অঞ্চলের বরফ গলা ত্বরান্বিত করছে।

অপরদিকে তাপদাহ, ভারিবর্ষণ, মরুকরণ, সমুদ্রের উষ্ণতা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।প্রাকৃতিক পরিবেশের উদ্ভিদ ও প্রাণীদের জীবনচক্রের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে।তাছাড়া পরিবেশ বাস্তুসংস্থানের পরিবর্তনসহ খাদ্য উৎপাদন,উপকূলীয় অঞ্চল,মানুষের স্বাস্থ্য,পানি সম্পদ,কৃষি ও অর্থনীতিতে নানা ধরনের বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে।

ঋতু বৈচিত্র্যের পরিবর্তনের ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীনসহ অতিবৃষ্টির জন্য বন্যা এবং অনাবৃষ্টির জন্য খরার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার পৃথিবীতে নতুন নতুন রোগের বিস্তার ঘটছে। পৃথিবীব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্ববাসী ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছে। তাই জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ক্ষতিকর প্রভাব এখন সারাবিশ্বে আলোচিত বিষয়। আর এই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে।

ঙ) মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

নিম্নোক্ত তিনটি উপায়ে পরিবর্তিত জলবায়ুতে মানুষের উপর প্রভব বিস্তার করতে পারে। যেমন:

ব্যক্তির উপর জলবায়ুর প্রভাব

ব্যক্তির উপর জলবায়ুর বিশেষ করে নিম্নোক্ত প্রভাব সমূহ বিস্তার করে,

আহত: দুর্যোগের ফলে ঘর-বাড়ি, গাছ-পালা, ভবন ইত্যাদি ভেঙ্গে পড়ে। এসবের নিচে চাপা পড়ে বা ব্যক্তি সরাসরি দুর্যোগে আক্রান্ত হয়ে আহত হতে পারে। তবে সব দুর্যোগে মানুষের আহত হওয়ার পরিমাণ সমান নয়। যেমন: ভূমিকম্প, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, ভবন ধ্বস, সুনামির ফলে প্রচুর পরিমাণে মানুষ আহত হয়। আবার বন্যা,খরা, দীর্ঘস্থায়ী শীত বা কুয়াশায় মানুষের আহত হওয়ার পরিমাণ কম থাকে।

মৃত্যু: অত্যন্ত মর্মান্তিক হলেও প্রাণহানি দুর্যোগের অতি সাধারণ ঘটনা। এ মৃত্যুর সংখ্যা, শত শত থেকে শুরু করে হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষও হতে পারে। যেমন: ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় কয়েক লক্ষ লোক মারা যায়। আবার ২০০৭ সালে তার চেয়েও প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও বন্যায় আনুমানিক ২০,০০ লোক মারা যায়।

অঙ্গহানি: দুর্যোগের আগমন আকস্মিক, কিন্তু তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সারা জীবনের জন্য। তাই দেখা যায়, একটি দুর্যোগের প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতে যদি অন্য কোন দুর্যোগ এসে হাজির হয় তবে আক্রান্ত অঞ্চলে তা মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন।কিছু কিছু দুর্যোগ যেমন:

ভূমিকম্প, ভবন ধ্বস, ভূমি ধ্বংস, ঘূর্ণিঝড়ে গাছ-পালা বা বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়ার ফলে মানুষের অঙ্গহানি ঘটতে পারে,যার ফলে সৃষ্টি হয় পঙ্গুত্ব বা শারীরিক অক্ষমতা,যেমন:২০১৩ সালে ঢাকায় সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ায় অনেক মানুষের হাত,পা বা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ কেটে ফেলে তাদের উদ্ধার করা হয়।

শারীরিক রোগের বিস্তার: প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে পয়:নিষ্কাশন, বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা, সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে যায়। যার ফলে পরিবেশ নষ্ট হয় এবং সুপেয় পানির অভাবে সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া এবং তা মহামারি রূপ গ্রহণ করে। এতে করে শারীরিক অসুস্থতা, ভোগান্তি এবং মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়।

মানসিক অসুস্থতা: দুর্যোগের ফলে ব্যক্তি শুধু শারীরিক রোগে আক্রান্ত হয় না, মানসিক রোগ চরম রূপ ধারণ করে। শারীরিক রোগের সকলে আক্রান্ত হয় না তবে কম-বেশি সকলেরই দুর্যোগে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মৃত্যু, গুরুতর আহত, বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা ও ব্যবসায়িক ভবন ভেঙ্গে যাওয়া,

ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়া, ঘেরের মাছ ভেসে যাওয়া ইত্যাদি দুর্যোগ সৃষ্টির ফলে প্রত্যেকেই কম বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর তার প্রভাবে দুশ্চিন্তা, অমূলক ভয়, অমূলক চিন্তা-ভাবনা, হতাশা ইত্যাদি মানুষের মধ্যে দেখা দেয়। যার প্রভাবে মানসিক রোগের সৃষ্টি হয়।

খাদ্য ও পুষ্টির অভাব: দুর্যোগ ব্যক্তির গচ্ছিত খাবার এবং সম্পদের ক্ষতিসাধন করে, ঘর-বাড়ি ভেঙে যাওয়ার ফলে তাকে আশ্রয় নিতে হয় স্বল্প-স্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে। তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্যের ব্যবস্থা না থাকায় ব্যক্তিকে থাকতে হয় অনাহারে। দুর্যোগে আক্রান্ত জনসমষ্টির জন্য সরকারি এবং বেসরকারি ভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়।

কিন্তু অপর্যাপ্ততা,সমন্বয়হীনতা,কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি ইত্যাদি কারণে সমপরিমাণ খাবার পায়না। এর ফলে দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে যাওয়া, আয়ের উৎস নষ্ট হওয়া, নৈতিকতার অবনতি প্রভৃতি সৃষ্টি হয়।

পরিবারের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

ব্যক্তির ওপর জলবায়ুর সকল প্রভাব পরিবারকেও আক্রান্ত করে। তবে পরিবারের উপর দুর্যোগের আরো কিছু প্রভাব রয়েছে। যেমন:

আশ্রয়হীনতা: দুর্যোগে ঘর-বাড়ি ভেঙে যায়। যার ফলে পরিবারের সকলে আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত জায়গার অভাবে পরিবারের সকলকে একই স্থানে রাখা সম্ভব হয় না। নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা না থাকায় মানুষ নিরাপত্তাহীনতাই ভোগে।

নিকটজনে বিচ্ছেদ: মৃত্যু সব সময় মর্মান্তিক আর দুর্যোগের কবলে পড়ে মৃত্যু আরো বেশি মর্মান্তিক হয়। অনেক সময় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বা একমাত্র পুরুষ ব্যক্তির মৃত্যুতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা দরিদ্রতা এবং নিরাপত্তা হীনতায় ভূগতে থাকে।

দরিদ্রতা: দুর্যোগে গচ্ছিত সম্পদ, ক্ষেত-খামারের ফসল, গাছের ফল ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়। উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু, আহত বা আয় উৎস নষ্ট হওয়ায় আয় রোজগারের আর কোন সুযোগ থাকে না। যার ফলে পরিবারের সকলকে দারিদ্রতাই নিপতিত হতে হয়। এর ফলে মৌলিক চাহিদা যেমন: খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি পূরণ করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। উক্ত অবস্থায় তাদের বহিরাগত সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হয়।

পারিবারিক বিশৃঙ্খলা: দরিদ্রতা, অশান্তি ইত্যাদি দুর্যোগের কারণে পারিবারিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিবারের সম্পদ নষ্ট হওয়া, মৃত্যু বা আয়ের উৎস নষ্ট হওয়ায় পরিবারের প্রধানেরা মানসিকভাবে চাপের মধ্যে থাকতে পারে। আচরণে অসংলগ্নতা দেখা যায়। এমন অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, ভাই-বোনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, শিশুদের মানসিক বিকাশ যথাযথ না হওয়া ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। অনেক সময় পারিবারিক ভাঙ্গনও দেখা যায়।

নিরাপত্তাহীনতা: দুর্যোগে ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে,পরিবারের সবাইকে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয় আশ্রয় কেন্দ্রে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে গবাদি পশু ও অন্যান্য গৃহস্থালি জিনিসপত্র আশ্রয় কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে না। আর এক শ্রেণীর জনগণ এর সুযোগ গ্রহণ করে লুট-পাটে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে নারী ও শিশু নানা প্রকার নির্যাতনের শিকার হয়। তাই দুর্যোগে নিরাপত্তাহীনতা একটি বড় ধরনের সমস্যা।

শিশুর মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়া: দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট পারিবারিক বিশৃঙ্খলা বা ভাঙ্গন শিশুর মানসিক বিকাশে চরম বাধা হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া দরিদ্রতার কারণে শিশু স্কুলে যেতে এবং ঠিকমতো পড়া-লেখা চালিয়ে নিতে পারে না।

অনেক পরিবার সামান্য কিছু টাকা প্রাপ্তির আশায় শিশুকে বিভিন্ন কর্মে নিয়োগ করে।এ ধরনের ঘটনা শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করার পাশাপাশি সমাজে অন্যায়-অপরাধ বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

সামাজিক জীবনের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

ব্যক্তি মিলে পরিবার আর কয়েকটি পরিবার মিলে সমাজ গঠিত হয়। সামাজিক জীবনের উপর প্রভাব মানে ব্যক্তি জীবনের উপর প্রভাব। ব্যক্তির উপর প্রভাব মানে একজনের উপর প্রভাব। আর সমাজ জীবনের উপর প্রভাব মানে সমাজে সদস্য সকলের উপর প্রভাব। সামাজিক জীবনের উপর জলবায়ুর নিম্নোক্ত প্রভাব গুলো বিস্তার করতে পারে। যেমন:

জীবন ধারণ ব্যাহত: দুর্যোগের ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, গাছ-পালা, ক্ষেত-খামার, বাজার ইত্যাদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রাণহানি, আহত, সম্পদ নষ্ট ইত্যাদি মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে চরমভাবে ব্যাহত করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জরুরী সেবা প্রতিষ্ঠান, প্রশাসনিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে মানুষ স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। দুর্যোগ পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রস্তুতি ব্যবস্থার উপর এগুলোর প্রভাবের তীব্রতা নির্ভর করে।

জরুরী সেবা ব্যবস্থা ব্যাহত: দারিদ্রতা দূরীকরণ, পুনর্বাসন, চিকিৎসা ইত্যাদি জরুরি সেবা সরকারি বা বেসরকারি প্রচেষ্টায় প্রতিটি সমাজে পরিচালিত হয়। দুর্যোগের ফলে উক্ত সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ ভেঙ্গে পড়ে মানুষের ক্ষয়-ক্ষতির কারণে তারাও সেবা গ্রহণে আগ্রহী নয়। যার ফলে বিদ্যমান উন্নয়ন প্রচেষ্টা ব্যাহত হয় এবং তা পূর্বাবস্থায় ফিরে আনতে প্রচুর অর্থ ও সময়ের প্রয়োজন হয়।

প্রশাসনিক ব্যবস্থা ব্যাহত: কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে প্রশাসন একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত হয়। দুর্যোগ সম্পূর্ণ অবস্থার ব্যাহত ঘটায়। তাই প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থা থেকে জরুরি অবস্থার দিকে পরিচালিত হয়। পর্যাপ্ত লোকবল ও ব্যবস্থাপনার অভাবে এ রকম অবস্থা বেশি মারাত্মক হয়। তাই আগে থেকে প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।

জাতীয় অর্থনীতির ক্ষতি: দুর্যোগের ফলে সম্পদ ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে স্বাভাবিক উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হয়। তাছাড়া দুর্যোগের পরে উদ্ধার, ত্রাণ বিতরণ এবং উন্নয়ন ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের ফলে প্রচুর অর্থের ব্যয় হয়। এভাবে যদি বারবার দুর্যোগ ঘটে তবে জাতীয় অর্থনীতির চাকা অচল হয়ে পড়বে। তাই আমরা দেখি দুর্যোগ আক্রান্ত দেশসমূহ অর্থনৈতিকভাবে অন্যান্য দেশে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এজন্য উন্নত বিশ্বের সহযোগিতার হাত প্রসার করা অত্যন্ত জরুরি।

শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাহত: দুর্যোগের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে যায়,বা প্লাবিত হয়। রাস্তা-ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ দুর্যোগের সময় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যার কারণে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। তাছাড়া বন্যা বা বৃষ্টির পানিতে বাধ্যতামূলকভাবে শিক্ষা বন্ধ রাখতে হয়। তাছাড়া বন্যা বা বৃষ্টির পানিতে শিক্ষার্থীদের বই নষ্ট হয়ে যায় ইত্যাদি সমস্যা সৃষ্টি হয়।

দুর্ভিক্ষ: দুর্যোগে ক্ষেত খামারের ফসল সমূলে নষ্ট হয়ে যায়। গচ্ছিত খাদ্য নষ্ট হয়ে যায়। অন্যান্য উৎপাদন ব্যবস্থাও চরমভাবে ব্যাহত হয়। যার কারণে চরমভাবে খাদ্যের অভাব দেখা যায়। খাদ্য ও পুষ্টির অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। এ কারণে জরুরী ভিত্তিতে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা খুবই জরুরী।

অপরাধ বৃদ্ধি: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহুলোক বেকার হয়ে পড়ে। তাদের জন্য চাই খাদ্য। এ খাদ্য যোগাড় করতে অনেকে বেছে নেয় চুরি, ডাকাতিসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে।

দারিদ্র বিমোচন বাধাগ্রস্ত: দারিদ্র বিমোচনে আমরা নিরস্তর সংগ্রাম করছি।এ অবস্থায় কোন দুর্যোগ দেখা দিলে দরিদ্র জনগণ আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। ফলে দারিদ্র বিমোচন বাধাগ্রস্থ হয়।

সামাজিক সমস্যার বিস্তার: সামাজিক সমস্যা হল একটি অবাঞ্চিত অবস্থা যা সমাজের স্বাভাবিক কাজকর্মকে বাধাগ্রস্থ করে এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষকে আক্রান্ত করে। সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি এবং তার বিস্তারের জন্য দুর্যোগ অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়।

দুর্যোগের ফলে নানাবিধ সামাজিক সমস্যা যেমন: ভিক্ষাবৃত্তি, বস্তি সমস্যা, সামাজিক অপরাধ, চুরি-ডাকাতি, নারী নির্যাতন ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। যেহেতু দুর্যোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এসব সমস্যার বিস্তার করা সম্ভব।

অবকাঠামোগত দুরবস্থা: মানুষের ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি দুর্যোগের ফলে ভেঙ্গে পড়ে। এগুলো নতুন করে নির্মাণ করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট আক্রান্ত দেশ বা সমাজের একার সামর্থ্যে তা পুনঃনির্মাণ করা সম্ভব নয়।

অবকাঠামোগত দুরবস্থার কারণে,দারিদ্রতা বৃদ্ধি পায়,অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে,উন্নয়ন কার্য পরিচালনা করা যায় না, জনগণ শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।

চ) ভূমির উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূমির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূমির পরিবর্তন সংঘটিত হতে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ১৪ টি জেলা-ভোলা, বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নিয়ে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার এলাকার জুড়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার বিস্তৃত।

উপকূল থেকে ১৫০ কিলোমিটার এর মধ্যে বসবাস করে পৃথিবীর প্রায় ৩৭% লোক। আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগে ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস, নীলনদ, সিন্ধু নদ প্রভৃতি উপকূল ভাগে কৃষিভূমি পরিবেষ্টিত কিছু সুপরিকল্পিত নগরের উদ্ভব ঘটেছিল। পৃথিবীর আজকের পরিবেশ ও আদি পরিবেশ কখনই এক ছিল না। পরিবেশ ক্রমানয়ে বদলাচ্ছে আর এসব পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখে ধীরে ধীরে বদলচ্ছে তার প্রকৃতি।

পৃথিবীর জীবনের আবির্ভাবের পর থেকেই জীব জগৎ সব সময়ই পরিবেশ পরিবর্তন বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। জীবজগতের মধ্যে মানুষই প্রকৃতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রাখে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিভিন্ন সময়ে সৃষ্টি হচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, মরুকরণ প্রক্রিয়া যার ফলে ভূমির উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে।

শেষ কথা:

বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লক্ষ্যণীয় পরিবর্তন ঘটতে পারে যেমন: বৃষ্টিপাত পরিমাণ পরিবর্তন, ঘন ঘন তাপ প্রবাহ, বন্যা ও খরার প্রাদুর্ভাব, পানির প্রয়োজন ও যোগানের পার্থক্য, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কৃষি ক্ষেত্রে ফলনের খারাপ প্রভাব, ইকোলজিতে পরিবর্তন, বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি এবং মানুষের স্বাস্থ্যের লক্ষণীয় প্রভাব পড়তে পারে। যদিও বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্র একই ভাবে এবং একই মাত্রায় হয়তো দেখা যাবে না। আজকের আর্টিকেলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url