থাইরয়েড কি- থাইরয়েড রোগের কারণ-লক্ষণ ও প্রতিকার।
আপনারা কি জানেন থাইরয়েড কি এবং এর কাজ কি। বর্তমানে থাইরয়েড রোগ বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। থাইরয়েড সম্পর্কে যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের পোষ্টি আপনাদের জন্য।কেননা আজকেরআর্টিকেলে আপনাদের কে থাইরয়েড কি-থাইরয়েড রোগের কারণ-লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হবে।
দেশে অন্য যে কোন রোগের চেয়ে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা বেশি। তাই অনুরোধ রইল আজকের আর্টিকেলটি সম্পূর্নটা পড়তে। তাহলে আপনারা জানতে পারবেন থাইরয়েড কি- থাইরয়েড রোগের কারণ- লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে।
থাইরয়েড কি
প্রথমে জানতে হবে থাইরয়েড কি।থাইরয়েড একটি গ্রন্থির নাম, যেটা গলার নিচের দিকে থাকে।এটা প্রজাপ্রতি আকারের গ্রন্থি যা গলার মাঝখানে অর্থাৎ ভয়েস বক্সের নিচে এবং শ্বাসনালীর ( ট্রাকিয়া ) চারপাশে আবৃত,এটি একটি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি। আর এ গ্রন্থি শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে। বর্তমানে বিশ্বজুড়েই থাইরয়েডের সমস্যা বাড়ছে। যখন আপনার শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থি ঠিক মতো কাজ করে না ,তখন পুরো শরীরে এর প্রভাব দেখা যায়।
বাংলাদেশে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ। দেশে অন্য যে কোন রোগের চেয়ে থাইরয়েড রোগীর সংখ্যা বেশি। থাইরয়েডের কাজ হল হরমোন সিক্রেট করা যা শরীরের কাজকে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে থাইরয়েড গ্রন্থির নানা সমস্যা বিশ্বে অন্যতম হরমোনজনিত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। হরমোনজনিত রোগের ক্ষেত্রে ডায়াবেটিসের পরই এর অবস্থান। মূলত নারীরাই এই সমস্যায় বেশি ভুগে থাকেন।
থাইরয়েড রোগের কারণ
থাইরয়েড রোগের কারণ মূলত বেশ কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয় যেমন:
- জেনেটিক থাইরয়েড রোগের কারণ হতে পারে অর্থাৎ যদি মা, বাবা, দাদার থাকে অথবা পূর্বপুরুষের থাকে সেই ক্ষেত্রে জেনেটিক লিংকে থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে। একে হাসিমোটো-র থাইরয়েডাইটিস বলে। এটা একটা অটোইমিউন অবস্থা যেখানে শরীরের কোষ গুলি থাইরয়েডকে আক্রমন করে এবং ক্ষতি করে।
- থাইরয়েড রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল আয়োডিনের অভাব । থাইরয়েড গ্রন্থি হরমোন উৎপাদন করতে আয়োডিন ব্যবহার করে।আয়োডিনের অভাবে বিশ্বের অসংখ্য মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তার ভিতর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো গয়টার। গলার নিচের দিকে ফুলে যাওয়াকে গয়টার বলে। এই গয়টার একটি বড় সমস্যা আমাদের দেশে।
- থাইরয়েড রোগের কারণ হিসেবে ধরা হয় প্রসব পরবর্তী অবস্থায় ৫% থেকে ৯% মহিলাদের মধ্যে এই থাইরয়েড সমস্যা হতে দেখা যায়।
- থাইরয়েডের চিকিৎসার জন্য যদি কেউ রেডিও আয়োডিন খেয়ে থাকে তাহলে থাইরয়েডের সমস্যা হতে পারে।
- কখন কখন থাইরয়েড গ্রন্থি জন্ম থেকেই সঠিক ভাবে কাজ করে না ফলে এসব শিশওদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশ ঘটেনা। তাই সমস্ত নবজাতককে তাদের জন্মের পরেই থাইরয়েডের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে একটি স্ক্রিনিং রক্ত পরীক্ষা করা উচিত।
- থাইরয়েড রোগের কারণ হিসেবে ধরা যায় যদি গলার সার্জারী হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রেও থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
থাইরয়েড রোগের প্রকারভেদ
থাইরয়েড রোগ মূলত ২প্রকার যেমনঃ
১। হাইপোথাইরয়েডিজম।
২।হাইপারথাইরয়েডিজম।
১। হাইপোথাইরয়েডিজম।
২।হাইপারথাইরয়েডিজম।
১। হাইপোথাইরয়েডিসম
মানব শরীরে থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম হরমোন উৎপন্ন হয় এক্ষেত্রে এই সমস্যাটি হওয়ার অধিক সম্ভাবনা থাকে। যদিও বা কম হরমোন নিঃসরণের ক্ষেত্রে প্রথমে তেমন একটা লক্ষণ চোখে পড়ে না। তবে পরবর্তীতে এটা গুরুতর আকার ধারন করে।
হাইপোথাইরয়েডিজম এর লক্ষণ বা থাইরয়েড রোগের লক্ষণ
- অধিক পরিমান চুল উঠে যাওয়া,
- অধিক পরিমান মোটা হয়ে যাওয়া,
- অনিয়মিত মাসিক হওয়া,
- কোষ্ঠকাঠিন্য,
- বন্ধাত্ব হওয়া,
- ত্বক রুক্ষতা,
- শীত শীত অনুভব,
- অস্বাভাবিক হাড়ের বিকাশ,
- ক্লান্তি ও অবসাদগ্রস্থতা,
- ভুলো মন,
- অমনোযোগী,
- বিষন্নতা,
- পালস রেট স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যাওয়া,
- কর্কশ কন্ঠস্বর,
- পেশী এবং বিভিন্ন জয়েন্টে ব্যথা হওয়া,
- মাসিকের সময় অতিরিক্ত পরিমাণ রক্তক্ষরণ হওয়া।
,তাই কারো শরীরে যদি হঠাৎ করে এই লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে থাইরয়েড রোগ হয়েছে ।
২। হাইপারথাইরয়েডিসম
থাইরয়েড গ্রন্থি যদি প্রয়োজনের তুলনায় অধিক বেশি হরমন উৎপাদিত হয় এবং নিঃসরণ ঘটে তাহলে একে হাইপারথাইরয়েডিজম বলে। থাইরয়েড গ্রন্থিতে যদি প্রদাহ সৃষ্টি হয় তাহলে এই রোগ টি হতে দেখা যায়। এটি কে গ্রেভস ডিজিজ ও বলা হয়। হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে গয়টারের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
এক্ষেত্রে হাইপারথাইরয়েডিজম এর লক্ষণ বা থাইরয়েড রোগের লক্ষণ হিসেবে যেগুলো দেখা দেয়– সেগুলো হচ্ছেঃ
- অসহ্য গরমের অনুভূতি,
- চোখ বেরিয়ে আসা,
- অতিরিক্ত ঘাম,
- অস্থিরতা,
- দ্রুত ওজন কমে যাওয়া,
- ঘুমে অনিয়ম,
- অধিক পরিমান চুল পড়া,
- গায়ের রং বিবর্ন হওয়া,
- গলা স্বরের পরিবর্তন হওয়া,
- পালসেট বেড়ে যাওয়া,
- ঘন ঘন মলত্যাগ করা,
- দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ-বিষন্নতা বেড়ে যাওয়া,
- হজমে গড়বর ,
- ত্বকের চামড়া পাতলা হয়ে যাওয়া,
- মহিলাদের ঋতুস্রাবে অনিয়ম এবং অল্প ব্লিডিং,
- হৃদস্পন্দন অধিক বেড়ে যাওয়া,
থাইরয়েড রোগের প্রতিকার
কিছু নিয়ম কানন মেনে চললে থাইরয়ে রোগ প্রতিকার করা সম্ভব। প্রথমত থাইরয়েড রোগীদের খাদ্য তালিকায় কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়াও থাইরয়েড রোগ প্রতিকারের জন্য কিছু শারীরিক ব্যায়াম প্রয়োজন। থাইরয়েড রোগ প্রতিকার করার জন্য নিচে থাইরয়েড রোগীদের খাদ্য তালিকা ও থাইরয়েড রোগ প্রতিরোধের কিছু সহজ টিপস দেওয়া হলো।
থাইরয়েড রোগ প্রতিকারের কিছু সহজ টিপস
থাইরয়েড রোগ প্রতিকার করার জন্য কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে যেমন
- প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্য এড়িয়ে চলুন।কারণ প্রক্রিয়াজাত করা খাবারের অনেক রাসায়নিক উপাদান থাকে যা থাইরয়েড হরমোন তৈরীকে প্রভাবিত করতে পারে। যেকোন ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এড়িয়ে চলতে হবে। এই সমস্ত খাবারে লবণ, চিনির ও তেলের পরিমাণ বেশি থাকে। যা ওজন দ্রুত বাড়াতে পারে।
- সোয়া পন্য এড়িয়ে চলুন।কারণ এটি থাইরয়েড হরমোন তৈরীকে প্রভাবিত করে। তাই সয়াবিন, সয়ার দুধ,সয়া তেল এড়িয়ে চলুন।
- থাইরয়েড থাকলে কিছু সবজি এড়িয়ে চলুন। যেমনঃ ফুলকপি, বাঁধাকপি , ব্রকলি, পালং শাক একেবারেই এড়িয়ে চলতে হবে কারণ এই শাকসব্জিতে গয়ট্রোজেন থাকে যা থাইরয়েড গ্রন্থির আয়োডিন শোষণে বাধা দেয় এবং হাইপারথাইরয়েডিজমকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
- মানসিক চাপ কম করুন কারন থাইরয়েড রোগ সহ অনেক স্বাস্থ্য ব্যাধিতে মানসিক চাপের অবদান হল অন্যতম প্রধান। তাই মানসক চাপ কম করার চেষ্টা করুন। এ জন্য সক্রিয় হন, ধ্যান করুন, যোগব্যায়াম চেষ্টা করুন এবং যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমান।
- ধূমপান বন্ধ করতে হবে কারন ধূমপানের সময় নির্গত টক্সিন থাইরয়েড গ্রন্থিকে বেশি সংবেদনশীল করে তুলতে পারে যা থাইরয়েড রোগের কারণ হতে পারে।
থাইরয়েড রোগীদের খাদ্য তালিকা
যেকোনো রোগের কবল থেকে বাঁচতে চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই। চিকিৎসা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া থাইরয়েড রোগ প্রতিকার করার জন্য ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন এবং আয়োডিন,যুক্ত খাবার গ্রহন করতে হবে যা শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
এছাড়া তিসি বীজ, চিয়া বীজ,গাজর, টমেটা,সবুজ শাক সবজি,বিভিন্ন ধরনের ফলমূল ,আদা লেবু অঙ্কুরিত ছোলা ,লাল চাল,লাল আটা,টক দই, কাজু বাদাম,ডিম,মাংস,সামুদ্রিক মাছ,ডাল,চিজ, নারকেল ,কুমড়া বিজ ,মধু,দুধ,এই খাবারগুলোতে প্রচুর পরিমান আয়োডিন ও প্রোটিন রয়েছে। আর শরীরে আয়োডিন এবং প্রোটিন মিশে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। এজন্য অবশ্যই এই খাবারগুলো থাইরয়েড রোগীদের জন্য উপকারী। এই খাবার গুলো নিয়মিত খেলে থাইরয়েড রোগ প্রতিকার করা সম্ভব।
আরো পড়ুনঃ ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি
সেই সাথে আরেকটি বিশেষ ব্যবহারকারী জিনিস হচ্ছে নারকেল ও সূর্যমুখীর তেলের ব্যবহার। যা থাইরয়েড গ্রন্থের সক্রিয়তা বাড়ায়। তাই এটি ব্যবহারের পাশাপাশি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করলে উপকার পাওয়া যায়। থাইরয়েড রোগিদের এসবের পাশাপাশি ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। এছাড়া প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে হাটতে হবে এবং ৬থেকে ৭ ঘন্টা প্রতিদিন নিয়মিত ঘুমাতে হবে।তাহলে থাইরয়েড রোগ প্রতিকার করা সম্ভব।
থাইরয়েড ক্যান্সার
যাদের মাথা, ঘাড় বা বুকে বিকিরণ বা রেডিয়েশন দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে থাইরয়েড ক্যান্সার বেশি হতে দেখা যায়। যাইহোক, এটি তাদের মধ্যেও ঘটতে পারে যাদের ঘাড় বা বুকে বিকিরণ বা রেডিয়েশন দেওয়া হয়নী । থাইরয়েড ক্যানসার অনেক সময় ভয়ানক রুপ ধারন করে।আবার দেখা যায় চিকিৎসাও অনেক ব্যায় বহুল।
থাইরয়েড ক্যান্সারের চারটি প্রধান প্রকার রয়েছে: প্যাপিলারি থাইরয়েড ক্যান্সার, ফলিকুলার থাইরয়েড ক্যান্সার, অ্যানাপ্লাস্টিক থাইরয়েড ক্যান্সার এবং মেডুলারি ক্যান্সার। বেশিরভাগ থাইরয়েড ক্যান্সারের সফলভাবে চিকিৎসা করা সম্ভব। তবে অবশ্যই ভালো চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
শেষকথা
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে এই আর্টিকেলে থাইরয়েড কি-থাইরয়েড রোগের কারণ- লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। আশা করি আপনারা থাইরয়েড কি- থাইরয়েড রোগের কারণ- লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।
থাইরয়েড রোগিদের নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে।জীবন যাত্রার কিছু পরিবর্তন এ রোগকে নিয়ন্ত্রন রাখতে সাহায্য করবে। আয়োডিনের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ রোগ হয়ে থাকে তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় অবশ্যই কিছু আয়োডিন যুক্ত খাবার গ্রহন করতে হবে। এছাড়া পুষ্টিকর খাদ্য এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহন করতে হবে।