কিডনি ভালো রাখার উপায় কি জেনে নিন

আপনি কি জানেন কিডনি মানব শরীরের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। মানুষ যেসব প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় তার মধ্যে কিডনি রোগ অন্যতম। আজকের আর্টিকেলে কিডনি ভালো রাখার উপায় কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

কিডনি ভালো রাখার উপায় কি জেনে নিন

যদি কিডনি ভালো রাখতে চান তাহলে আজকের আর্টিকেলটি সম্পন্ন পড়ার অনুরোধ রইলো।কারণ আজকের আর্টিকেলে কিডনি ভালো রাখার উপায় কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করব।

ভূমিকা

কিডনি মানব দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। কিডনি রক্তের উপস্থিত দূষিত পদার্থগুলো পরিশোধন করে এবং প্রস্রাবের দ্বারা সেই দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। অর্থাৎ কিডনি শরীরের ছাঁকুনি বা ফিল্টারের মতো কাজ করে। কিডনি রক্ত পরিশোধন করে এবং শরীরে পানি ও লবণের ভারসাম্য বজায় রাখে।


রক্ত নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি হরমোন রেনিন যা কিডনি থেকে নিঃসারিত হয়। প্রতিদিন একটি কিডনি ১২০ থেকে ১৫০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে এবং ১ থেকে ২ লিটার দূষিত বর্জ্য শরীর থেকে বের করে দেয়। তাই কিডনিতে সমস্যা হলে শরীরের সবকিছুই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে।

কিডনি ভালো রাখার উপায় কি

দৈনন্দিন জীবনে কিছু নিয়ম কানুন ও শৃঙ্খলা মেনে চললে কিডনি সুস্থ রাখা সম্ভব। কিডনি ভালো রাখতে কিছু নিয়ম-কানুন চলুন জেনে নেওয়া যাক-

পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা

কিডনি ভালো রাখার জন্য প্রত্যেকটি মানুষকে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করা অতি জরুরী। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করতে হবে। শরীরে পানি শূন্যতা হলে কিডনিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়।

তবে অতিরিক্ত পানি পান করলে কিডনি ভালো থাকে এ কথাটা সত্য নয়।যারা প্রখর রোদে কাজ করেন এবং অত্যাধিক কায়িক পরিশ্রম করেন, ফলে শরীরে অধিক ঘাম হয়। তাদের ক্ষেত্রে পানি অধিক খাওয়া জরুরী।

কিন্তু যারা স্বল্প পরিশ্রম করেন এবং এসি বা এয়ার কুলারের মধ্যে থাকেন তাদের শরীরে ঘামটা হয় কম,সেক্ষেত্রে তাদের খুব বেশি পানি খাওয়ার প্রয়োজন নেই। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির যাতে সারাদিনে ২ লিটার প্রস্রাব হয় সেদিক খেয়াল করে পানি পান করতে হবে।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা

আমাদের দেশের অধিকাংশ কিডনি রোগীরাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে কিডনিতে বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি হয়। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মনে রাখা উচিত।

কিডনি অনেকটা বিকল হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তেমন কোন উপসর্গ প্রকাশ পায় না।যখন উপসর্গগুলো প্রকাশ পায় তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত।

এছাড়াও প্রতি ছয় মাস পর পর সেরাম ক্রিয়েটিনিন ও প্রসাবের আমিষের পরিমাণ পরীক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ ডায়াবেটিস রোগীরা যদি রক্তের সুগারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে তাহলে সহজেই কিডনি ভালো রাখা সম্ভব।

উচ্চ রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখা

বর্তমানে দেখা যায় মানুষের জীবনযাপন অধিক স্ট্রেস ফুল। জীবন যন্ত্রণার কারণে অর্থাৎ অধিক স্ট্রেসের কারণে প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে যে কোন বয়সে। সবচেয়ে বেশি কিডনি নষ্ট হয় অতিরিক্ত প্রেসারের কারণে।

উচ্চ রক্তচাপের কারণে আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে স্থায়ীভাবে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি নষ্ট হয়ে যাওয়াকে বলা হয় CKD বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ। এজন্য রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা অতি জরুরী।

একবার যদি কিডনি বিকল হয়ে যায় স্থায়ীভাবে তাহলে কিডনি পরিবর্তন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এজন্য যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে,তারা অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ঔষধ খাবেন এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করবেন।

স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলা

কিডনি ভালো রাখার জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এজন্য খাদ্য তালিকায় প্রচুর পরিমাণ ফলমূল,শাকসবজি,ডাল জাতীয় প্রোটিন ও মাছ রাখতে হবে। প্রতিদিন সময় মতো ও পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করা উচিত।

কারণ অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ আবার কিডনির জন্য ক্ষতিকারক। অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন যেমন: গরুর মাংস,খাসির মাংস খাওয়া উচিত নয়। কারণ অতিরিক্ত প্রাণিজ প্রোটিন কিডনির জন্য অধিক ক্ষতিকর।

যাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের পুঁইশাক,পালংশাক,কচু,কচু লতি,কচুর শাক,গাজর, মুলা,ফুলকপি এড়িয়ে চলা উচিত। এছাড়াও কামরাঙ্গা, আমলকি ফল যা কিডনির জন্য অধিক ক্ষতিকারক।

চিকিৎসকরা অধিক পরিমাণ কামরাঙ্গা ও আমলকি খেতে নিষেধ করেন। অধিক পরিমাণ আমলকি ও কামরাঙ্গা খেলে ভালো কিডনি খুব সহজেই বিকল হয়ে যেতে পারে। কিডনি ভালো রাখতে প্রক্রিয়াজাত করা খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।

এছাড়াও চিপস,নুডলস,ফাস্টফুড,বিভিন্ন ভাজাপোড়া,অধিক মসলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। এছাড়াও কিডনি ভালো রাখার জন্য ভিটামিন ডি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত এবং অতিরিক্ত সোডিয়াম যুক্ত খাবার পরিহার করা অত্যন্ত জরুরী।

কাঁচা লবণ পরিহার করা

কিডনি ভালো রাখার জন্য কাঁচা লবণ খাওয়া পরিহার করতে হবে। মানুষের শরীরের প্রতিদিন মাত্র ১ চা চামচ লবনের চাহিদা থাকে। অধিক পরিমাণ কাঁচা লবণ খেলে কিডনিতে পাথর হওয়া সম্ভাবনা থাকে এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়।

অতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার পরিহার করা

অতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। অতিরিক্ত চিনি যুক্ত খাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি ব্রেইনকেও ড্যামেজ করে ফেলে। অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার কিডনিকে বিকল করতে পারে।পাশাপাশি অধিক চিনি যুক্ত খাবার খেলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয় এবং মস্তিষ্কের ঘনত্বের পরিমাণ অনেক কমে যায়।

অধিক ভিটামিন সি যুক্ত খাবার পরিহার করা

অধিক ভিটামিন সি যুক্ত খাবার কিডনিতে পাথর সৃষ্টি করে। মানুষের শরীরে দৈনিক ভিটামিন সি এর চাহিদা ৫০০ মিলিগ্রামের বেশি নয়। তাই কিডনি ভালো রাখতে প্রতিদিন ৫০০ মিলিগ্রাম এর কম ভিটামিন সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করুন।

কোমল পানীয় পরিত্যাগ করা

বর্তমানে ছোট বড় প্রায় সকলেরই কোমল পানীয় অর্থাৎ এনার্জি ড্রিংস গুলো খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই এনার্জি ড্রিংস গুলো কিডনির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তাই কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে এ ধরনের কোমল পানীয় পরিত্যাগ করা অতি জরুরী।

অধিক মসলাযুক্ত খাবার পরিহার করা

কিডনি আমাদের দেহে ছাঁকুনির ন্যায় কাজ করে। কিডনি শরীরের দূষিত পদার্থ রক্ত থেকে আলাদা করে প্রস্রাবের দ্বারা বের করে দেয় এবং শরীরে পানির ভারসাম্য বজায় রাখে। আর প্রতিনিয়তই যদি আমরা মসলাযুক্ত খাবার গ্রহণ করি।

তাহলে এক সময় কিডনির ছাঁকুনির যে কার্যকারিতা শক্তি সেটা দুর্বল হয়ে পড়ে। সুতরাং কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে মসলাযুক্ত খাবার অবশ্যই এড়িয়ে চলতে হবে।

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমানো

কিডনি ভালো রাখার জন্য প্রত্যেকটি মানুষেরই ঘুম অত্যন্ত জরুরি। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য প্রতিদিন ৭ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুম অতি জরুরী। কারণ ঘুমের মধ্যে ব্রেন বিশ্রাম পায়। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমালে মানুষের ভেতরের ইন্টার্নাল অর্গান ভালো থাকে।

সুতরাং কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম অতি জরুরি। কারণ গবেষকরা জানান,অল্প ঘুম কিডনির কার্যক্রম দ্রুত কমিয়ে দেয়।

নিয়মিত ব্যায়াম করা

প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম কিডনির পাশাপাশি সামগ্রিক শরীরের জন্য অনেক ভালো। নিয়মিত ব্যায়াম করলে উচ্চ রক্তচাপ কমে। চিকিৎসকরা নিয়মিত ২০ থেকে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। নিয়মিত ব্যায়াম করলে কিডনির বিভিন্ন ধরনের রোগ প্রতিরোধ হয়।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা

কিডনি ভালো রাখার জন্য অবশ্যই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কারণ ওজন বাড়তে থাকলে কিডনির উপর চাপ পড়ে।এক গবেষণায় দেখা গেছে যাদের অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বেশি তাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি অনেকটাই বেশি।

ধুমপান ও মাদকের সেবনের অভ্যাস ত্যাগ করা

ধূমপান একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপদজনক অভ্যাস।কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে অবশ্যই ধূমপান ও মাদক সেবনের অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। ধূমপান ও মাদক সেবনের কারণে শরীরে রাসায়নিক বর্জ্য জমা হতে থাকে ফলে কিডনিতে রক্ত চলাচল কমে যেতে পারে।

এতে করে কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস পায়। ধূমপান ও মাদক সেবনের কারণে কিডনিতে ক্ষতি হওয়ার সাথে সাথে হার্ট ব্লক,ব্রেন স্ট্রোক,স্মৃতিশক্তি লোপ,লিভার প্রদাহ,ব্রেইন টিউমার,ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।

দীর্ঘ সময় প্রস্রাব ধরে রাখার অভ্যাস ত্যাগ করা

কিডনি ভালো রাখার জন্য অবশ্যই দীর্ঘ সময় প্রস্রাব ধরে রাখার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। সকল বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের দ্বারা শরীর থেকে বের হয়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব ধরে রাখলে শরীরের ভেতরে এই বর্জ্য জমে যেতে পারে।

ফলে মূত্র থলিতে বিভিন্ন সংক্রমণ সৃষ্টি হয় এবং এই বর্জ্য জমে কিডনিতে পাথর সহ বিভিন্ন ধরনের কিডনির রোগের সৃষ্টি হয়। সুতরাং কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে সঠিক সময়ে মূত্র ত্যাগের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।

ঔষধ সেবনে সতর্ক হওয়া

মুঠো মুঠো ঔষধ খাওয়া পরিহার করা উচিত। কারণ প্রায় সকল ঔষধই কিডনির জন্য ক্ষতিকারক। বিশেষ করে ব্যাথানাশক ঔষধ পরিহার করা অতি জরুরী। কারণ ১টি ব্যাথানাশক ঔষধই আপনার কিডনিকে বিকল করে ফেলতে পারে। তাই ব্যথার ঔষধ যখন তখন খাওয়া উচিত না।

নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা

কিডনি ভালো রাখার উপায় হিসেবে নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা অতি জরুরী। যারা বংশগতভাবে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগে ভুগছেন তাদের অবশ্যই নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করা উচিত।

শেষ কথা

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে উপরোক্ত বিষয় মেনে চললে কিডনি রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব। আজকের আর্টিকেলে কিডনি ভালো রাখার উপায় কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url