ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি
প্রিয় পাঠক আপনারা কি জানেন ব্রেইন টিউমার কি? আর যদি না জেনে থাকেন তাহলে আজকের আর্টিকেলটি আপনার জন্য। কেননা আজকের আর্টিকেলে ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি, ব্রেইন টিউমারের লক্ষণ,বাংলাদেশে ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাই ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি আপনাদের জানা অতি জরুরী।তাই সম্পন্ন আর্টিকেল পড়ার অনুরোধ রইলো।
ভূমিকা
ব্রেইন টিউমার একটি ঘাতক ব্যাধি। ব্রেইন টিউমার হলে মোটামুটি ধরে নিতে হবে মৃত্যু অবধারিত। সচেতনতাই পারে আমাদের এই ব্রেইন টিউমারের হাত থেকে বাঁচাতে। সাধারণত ব্রেইনের অধিকাংশ টিউমার ক্যান্সারের রূপান্তরিত হয়। যার ফলে অধিকাংশ রোগী মারা যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রচুর সময় ও অর্থ খরচ করে বেঁচে ফেরা সম্ভব। ব্রেইন টিউমার যেকোনো বয়সেই হতে পারে। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকে বেড়ে যায়। ৩৫ বছর পার হলে মাঝে মাঝে ব্রেইন পরীক্ষা করা জরুরী।
ব্রেইন টিউমার কি?
শরীরে যে কোন কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বলা হয় টিউমার। আর ব্রেইন টিউমার হল মস্তিষ্কের কোন কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। দেখা যায় এই টিউমার যখন বৃদ্ধি পায় তখন মস্তিষ্কের ভেতরে চাপ বেড়ে যায় যা মস্তিষ্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। চিকিৎসকের মতে সঠিক সময়ে ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা করা অতি জরুরী।
ব্রেইন টিউমারের লক্ষণ
ব্রেইন টিউমার হলে শরীরের বিভিন্ন লক্ষণ প্রকাশিত হয়। ব্রেইন টিউমার হলে শরীরে যেসব সমস্যা বা লক্ষণ প্রকাশিত হয় সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো।
- ব্রেইন টিউমারের প্রথম প্রাথমিক লক্ষণ হল প্রচন্ড মাথা ব্যথা করা।
- সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর তীব্র মাথাব্যথা অনুভব করা।
- ব্যায়াম করার সময় বেশি নড়াচড়া করলে বা কাশলে অধিক মাথাব্যথা অনুভব হয়।
- সারাদিন ধরে মাথাব্যাথা থাকা কিন্তু দিনের বিভিন্ন সময়ে তার তীব্রতার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
- অতিরিক্ত মাথা ব্যথার কারণে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ যেমন: বমি বমি ভাব অনুভব হয়।
- বিভিন্ন ব্যথার ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও মাথাব্যথা না কমা।
- ছোটখাটো সাধারণ বিষয়ে বিরক্তি অনুভব করা। অর্থাৎ আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে।
- সামান্যতেয় অতিরিক্ত ক্লান্তি বোধ বা অবসাদ হয়ে পড়া। সারাদিন ঘুম ঘুম ভাব থাকে।
- ব্রেইন টিউমার হলে হঠাৎ করে মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়া। এমনকি ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে দেখা যায়।
- ব্রেইন টিউমারের আরেকটি অন্যতম লক্ষণ হল খিচুনি। সাধারণত ৫০ শতাংশের বেশি ব্রেইন টিউমার রোগীদের ক্ষেত্রে এই খিচুনি লক্ষ্য করা যায়।
- একই সাথে একাধিক কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এবং স্মৃতি শক্তি কমে যাওয়া।
- দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া এবং উপরের দিকে তাকাতে অসুবিধা হওয়া।
- শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বিনষ্ট হওয়া। এছাড়াও রোগী হঠাৎ হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করনীয় কি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন সাধারণ কিছু নিয়ম ও স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা ও সুষম খাদ্য গ্রহণ ব্রেইন টিউমারকে দূরে রাখতে সাহায্য করে। তাই ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হল।
পর্যাপ্ত ঘুম
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিতে হবে। এজন্য প্রতিটি মানুষেরই পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন অন্তত সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমানো অতি জরুরি।পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমালে স্মৃতি শক্তি ভালো থাকে,রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়,সৃজনশীলতা বাড়ায়,ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে,মানসিক চাপ কমায় এবং হরমোনের মাত্রা স্বাভাবিক থাকে।
মোবাইল ও কম্পিউটারের সীমিত ব্যবহার
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে হলে মোবাইল ও কম্পিউটারের ব্যবহার সীমিত করতে হবে। মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার থেকে নিঃসৃত ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন ব্রেইন টিউমার তৈরির একটি অন্যতম কারণ।যার মধ্যে সিমের টাওয়ারের রেডিয়েশন ও মোবাইলের রেডিয়েশন অন্যতম।
এ কারণে স্বাস্থ্য সংস্থা WHO প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের উভয়ের জন্য সেলফোন ব্যবহার সীমিত করার পরামর্শ দেন।তাই বিশেষ করে ঘুমানোর আগে নিজের সেল ফোন অবশ্যই বন্ধ করে ঘুমানো উচিত। সুতরাং মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার ব্যবহারে একটু সতর্ক হলেই আমরা ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে পারি।
ধূমপান বর্জন করা
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই ধূমপান বর্জন করতে হবে। কারণ ধূমপান একটি মারাত্মক ক্ষতিকর ও বিপদজনক অভ্যাস। কারণ সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে তা হিরোইন অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী।ধূমপানের কারণে শরীরের তাপ বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও লিভার প্রদাহ, জ্বালাপোড়া রক্ত নালি দুর্বল হয়ে পড়া, ফুসফুস, মূত্রথলি, জিহবা, কণ্ঠনালী, কিডনি, ব্রেইন টিউমার, ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। সুতরাং ব্রেন টিউমারের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো ধূমপান করা।
মানসিক চাপ কমানো
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ অতিরিক্ত চিন্তা বা স্ট্রেস থেকেও হতে পারে ব্রেইন টিউমার। অধিক স্ট্রেসের ফলে শরীরে ইমিউনিটি সিস্টেম কমে যায়।তখন শরীরের মধ্যে সেলস মলিকিউল বলে কিছু জিনিস থাকে যার ফলে সমস্যা হয়। ফলে এর থেকেই টিউমার তৈরি হয়। এছাড়াও স্মৃতি শক্তি নষ্টের বড় কারণ হলো মানসিক স্ট্রেস
সুষম খাদ্য গ্রহণ
সুষম খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ব্রেইন টিউমারের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। যে খাবারগুলো মস্তিষ্ক ভালো রাখবে এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করবে সেই খাবারগুলো আমাদের খেতে হবে নিয়মিত। এন্টিঅক্সিডেন্ট এবং ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্য এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করতে দারুন কার্যকরী।
এছাড়াও কিছু খাবার আছে যেগুলো ব্রেইনের কোষের মৃত্যু আটকায় এবং স্মৃতিশক্তি ও বুদ্ধি বাড়াতে সাহায্য করে যেমন: সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল, ভিটামিন সি যুক্ত ফল, গ্রিন টি,চা ও কফি, পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি, বাদাম, কলা, ডিম, কলিজা, মিষ্টি কুমড়ার বীজ, সবুজ শাকসবজি, টমেটো, গাজর ইত্যাদি। এছাড়াও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে চিনি কম খাওয়া জরুরী।
বিভিন্ন ভিটামিন ঔষধ বর্জন করা
অকারণে অনেকেই ডায়েটে ভিটামিন জাতীয় ঔষধ রাখেন যা ব্রেইন টিউমারের কারণ হতে পারে। বিশেষ করে এর নাইট্রোসো জাতীয় ভিটামিন শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়ের মস্তিষ্কের ব্রেইন টিউমারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই সম্ভব হলে অকারণে ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার হতে বিরত থাকুন। প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
নিয়মিত ব্যায়াম করা
মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য ব্যায়াম অতি জরুরী।বিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন ব্যায়াম করলে মগজে নতুন কোষের জন্ম হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে হিপোক্যাম্পাস উত্তেজিত ও স্ফীত হয়ে ওঠে এবং স্মৃতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। প্রতিনিয়ত কার্ডিওভাসকুলার ব্যায়াম করলে মস্তিষ্কের অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ সরবরাহ হয় যা ব্রেইনের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে অবশ্যই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা মস্তিষ্কের মেনিনজিওমা নামক মস্তিষ্কের টিউমারসহ কিছু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতিবছর যুক্তরাজ্যের নির্ণয় করা ১০০ জনের মধ্যে দেখা যায় প্রায় ২জনের ব্রেইন টিউমার হয় অতিরিক্ত ওজনের কারণে। যাদের ওজন বেশি তাদের উচিত শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা।
মেডিকেল রেডিয়েশন থেকে সতর্কীকরণ
মেডিকেল রেডিয়েশন বা আয়নাইজিং বিকিরণ হল এক প্রকার বিকিরণ যা কিছু মেডিকেল টেস্টে ব্যবহার করা হয় যেমন: সিটি স্ক্যান,এক্সরে ইত্যাদি। ব্রেইন টিউমার সহ অনেক অসুস্থতার একটি অন্যতম কারণ এই স্ক্যান গুলো। যুক্তরাজ্যের এক নির্ণয় করা গবেষণায় প্রতি ১০০ জন ব্রেইন টিউমার রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীদের মেডিকেল স্ক্যান করার রেকর্ড ছিল।
তবে সব ধরনের স্ক্যান ও এক্সরে ঝুঁকিপূর্ণ নয়। বর্তমানে যে আধুনিক স্ক্যানার আবিষ্কার হয়েছে সেগুলোতে রেডিয়েশন অনেক কম। তাই ভালো হাসপাতালে এইসব এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান করা উচিত। কেননা ছোট হাসপাতালে ভালো মানের স্ক্যানার থাকে না।
রেডিওথেরাপি থেকে সতর্কীকরণ
রেডিওথেরাপি ব্রেইন টিউমার সৃষ্টির একটি অন্যতম কারণ। যুক্তরাজ্যের এক গবেষণায় দেখা গেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যারা এক্স-রে এবং সিটি স্ক্যান এর পরিবর্তে পূর্ববর্তী রেডিওথেরাপি চিকিৎসা থেকে রেডিয়েশন পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে টিউমার হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
সহজ কথায় যারা ক্যান্সারকে জয় করে এসেছেন তাদের ক্ষেত্রে এ রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হয়। এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে টিউমার কোষ গ্রোথ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পারলে প্রতিবছর একবার টেস্ট করা উচিত।পারলে একই সাথে মাথার গতিবিধি লক্ষ্য করা উচিত।
সুতরাং একটি কথা বলা অতি জরুরী ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি এ তথ্যটি আপনারা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন।
বাংলাদেশে ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা
বর্তমান বাংলাদেশে যেকোনো ধরনের ব্রেইন টিউমারের অপারেশন করা সম্ভব। অন্যান্য দেশের তুলনায় এমন কি প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও বাংলাদেশের ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা খরচ অনেক কম। ব্রেইন টিউমারের ধরন,আকার,তীব্রতা ও অবস্থানের উপর এর চিকিৎসা নির্ভর করে।
সাধারণত সার্জারি এরপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাধ্যমে ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা করা হয়। এছাড়াও লক্ষণের উপর ভিত্তি করে কিছু ঐষধ দেওয়া হয়।যেমন খিচুনি,বমি বন্ধের ওষুধ প্রভৃতি।
শেষ কথা
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করা ও নিয়মিত শরীর চর্চা করে ব্রেইন টিউমার ঠেকানো যায়।অতিরিক্ত কম্পিউটার, মোবাইল, টেলিভিশন, ইয়ারফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। এছাড়াও রেডিয়েশনের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
কোন সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। আজকের আর্টিকেলে ব্রেইন টিউমার থেকে বাঁচতে করণীয় কি, ব্রেইন টিউমারের লক্ষণ, বাংলাদেশে ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা অনেক উপকৃত হবেন।